জন্মগতভাবেই মানুষ কৌতূহলী ও ভ্রমণপ্রিয়াসী। চঞ্চলকর মানুষ একটু অবকাশ পেলেই ছুটে চলে দিক-দিগন্তে। সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রকৃতি ও মানুষ্য সৃষ্ট সৌন্দর্য, নানা নিদর্শন সে মানবীয় সত্তা দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতে চায়। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলীয় পর্যটন বহুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরে অপার লীলাভূমি চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবসর সময়কে আনন্দময় করে তোলার জন্য রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। শীতের সময়ে এসব আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের বরণ করতে প্রস্তুত। কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ছায়া নিবিড় পরিবেশে অবস্থিত নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ঝর্ণাধারা হামহাম জলপ্রপাত, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিমানবন্দর, দৃষ্টিনন্দন ক্যামেলিয়া লেক, সবুজে ঘেরা সারি সারি চা-বাগান, ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরীসহ অন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন যাত্রা পর্যটকদের মন ও দৃষ্টি কেড়ে নেবে।
লাউয়াছড়াকে ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝে সবচেয়ে দর্শনীয়, নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। পশুপাখি, বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাস স্থল। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় জীব উল্লুকসহ কয়েকটি জন্তু ও বিলুপ্ত প্রায় কয়েকটি মূল্যবান গাছ-গাছালির শেষ নিরাপদ আবাসস্থল এই লাউয়াছড়া। এ উদ্যানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। লাউয়াছড়া ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এখন একটি আকর্ষণীয় স্থান।
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের দৃষ্টিনন্দন স্থানের মধ্যে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিট একটি অরণ্যঘেরা গহীন দুর্গম পাহাড়। এর আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। কুরমা বনবিটের পাহাড়ের পশ্চিমদিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কি.মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত। স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীরা এ জলপ্রপাত ধ্বনিকে হামহাম বলে। তাই এটি হামহাম নামে পরিচিত। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে হেঁটে রওনা হতে হয়। প্রায় ৬ কি.মি. পাহাড় টিলা ও ২ কি.মি. ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘণ্টা হাঁটার পর ১৬০ ফুট উচ্চতার হামহাম জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যাবে। হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমণ করতে পুরো একদিনের প্রয়োজন হয়।
উপজেলার মাধবপুর চা-বাগানে নয়নাভিরাম মনোরম দৃশ্য মাধবপুর লেক। ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার পাহাড়ি উঁচু নিচু টিলার মাঝে দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কি.মি. পানির হ্রদ ও তার শাখা-প্রশাখা, চারপাশে পাহাড়ি টিলার ওপর সবুজ চা-বাগানের সমারোহ, জাতীয় ফুল দুর্লভ বেগুনী শাপলার আধিপত্য, ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া নিবিড় পরিবেশ, শাপলা-শালুকের উপস্থিতি আনন্দের বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। এক দিনেই মাধবপুর লেকের দৃশ্য উপভোগ করে বেরিয়ে এসে একই রাস্তায় প্রায় ১০ কি.মি. যাওয়ার পরই বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসা যায়। এখানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন এ স্মৃতিসৌধ দেখতে আসেন।
ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমশেরনগর চা-বাগানে দৃষ্টিনন্দন ক্যামেলিয়া লেকটির অবস্থান। ক্যামেলিয়া লেকটি পর্যটকদের স্বর্গোদ্যান হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন শিল্পে নতুন সংযোজন। এখানে যেতে কমলগঞ্জের শমশেরনগর-চাতলাপুর চেকপোস্ট সড়ক ধরে দক্ষিণ দিকে প্রায় ২ কিলোমিটার সামনে গেলেই হাতের ডানে দেখা মেলে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত চা-বাগানের শ্রমিক-কর্মচারীসহ প্রায় ৯০ হাজার জনসংখ্যার নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালের। হাসপাতালটিকে পেছনে ফেলে আরও ২ কিলোমিটার মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলবে প্রকৃতির নিজ হাতে তৈরি করা অপরূপ ও চোখ ধাঁধানো মায়াবী লেকটির। লেকের পাশের পুরোটাই বালুকাময়। লেকের পানিই ক্যামেলিয়া লেকের সৌন্দর্য মুগ্ধতা জাগানিয়া। নীল আকাশের নিচে চারদিকে ছোট-বড় পাহাড়ি টিলা ও সারি সারি চা-বাগান। সব সময়ই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চা বাগানের শ্রমিকদের কাছে এ লেকটি বিসলার বান বা ক্যামেলিয়া বাঁধ নামে পরিচিত। তবে এর প্রকৃত নাম ‘ক্যামেলিয়া লেক’।
ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ডবলছড়া। ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হওয়া একটি পাহাড়ি ছড়ার নামে স্থানটির নাম হয়েছে বলে জানা যায়। ডবলছড়া খাসিয়া পল্লি যেতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু কাঁচা ১২ কি.মি. রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার ডবলছড়া খাসিয়া পল্লিটি পাহাড়ি টিলার ওপর ঘর করে বসবাস করছে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকজন। একজন হেডম্যান বা মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে ডবলছড়া খাসিয়া পল্লিতে আড়াই শ’ ফুট উপরের হেডম্যান বা মন্ত্রীর বাংলোটি দেখতে খুবই সুন্দর।
এ ছাড়াও ভ্রমণের জন্য রয়েছে কমলগঞ্জে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের নীরব সাক্ষী বিভিন্ন বধ্যভূমি, ব্রিটিশদের শোষণের প্রতীক তিলকপুর নীলকুটি, ঘটনাবহুল মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ড, সারি সারি চা-বাগান, বর্ণময় শিল্পসমৃদ্ধ মনিপুরী ললিতকলা একাডেমিসহ টিপরা, খাসিয়া, গারোসহ অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর এলাকাসমূহ। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস অথবা ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল, ভানুগাছ, শমশেরনগর এসে এখান থেকে বাস-সিএনজি-অটোরিকশা, ট্যাক্সি করে পর্যটন স্পটগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব। প্রতিটি পর্যটন স্পটে স্থানীয় পর্যটন গাইডও রয়েছে। এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার জন্য হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান অ্যান্ড গলফ, শ্রীমঙ্গল। হীড বাংলাদেশ রেস্ট হাউস, কমলগঞ্জ। স্যুইস ভ্যালি রেস্ট হাউস, শমশেরনগর ছাড়া ও উপজেলায় স্থানীয় ডাকবাংলোসহ বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :