জানালার পাশের বিছানায় শুয়ে আছি, শরীর ভীষণ দুর্বল। জ্বরের ঘোর মাথার ভেতর অদ্ভুত বিভ্রম তৈরি করেছে। সময়ের হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘরটা একটা বিশাল খাঁচা, আর আমি তাতে বন্দি। ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো- জীবন আসলে কী? এই কষ্ট, এই যন্ত্রণা; এসব কি কেবল এক দিনের গল্প? না কি পুরো জীবনটাই এমন এক অসীম সংগ্রাম?
চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে আসছে, হঠাৎই দেখি, দরজার পাশে বন্ধু হাসেম দাঁড়িয়ে আছে! হাসেম; সেই ছেলেটা, যে ১৭ বছর আগে এক মিছিলে গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল। চোখ কচলে দেখি, না, ভুল দেখছি না। সে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
সে প্রশ্ন করল-‘কেমন আছিস, হারুন’?
আমি কিছু বলতে পারলাম না। ঠোঁট কাঁপছিল। এত বছর পরও তার মুখটা একদম আগের মতোই আছে, যেন সময় তাকে ছুঁতেই পারেনি।
আমি বললাম -‘তুই এখানে কীভাবে?’
-‘এসেছি তোকে দেখতে। তুই তো জীবন নিয়ে ভাবছিলি, তাই ভাবলাম একটু গল্প করা যাক।’
তার কথায় ভয় আর বিস্ময়ের মাঝেও একটা শান্তি লাগল। বিছানায় উঠে বসলাম।
-‘হাসেম, তোর জীবন তো অর্ধেকেই থেমে গেল। তোর কী মনে হয়, সবটা দেখে যেতে পারলে ভালো হতো?’
-‘জানিস, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, বেঁচে থাকলে হয়তো তোর মতোই হতাম। হাঁটতাম ধানমন্ডি লেকের ধারে, হয়তো কিছু বই পড়তাম, হয়তো কারো প্রেমে পড়তাম... কিন্তু সে সুযোগ পেলাম না। মিছিলে গিয়েছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, আর সেখানেই শেষ হয়ে গেলাম। কিন্তু বল তো হারুন, তুই কি এখনো বিশ্বাস করিস, সব বদলানো সম্ভব?’
তার প্রশ্নটা বুকের ভেতর ধাক্কা দিল। সত্যিই তো, আমি কি এখনো বিশ্বাস করি, পরিবর্তন সম্ভব?
আমি বললাম, ‘আজকাল মনে হয়, রাজনীতিতে মানুষের জন্য কাজ করার কথা বলা হয়, কিন্তু আসলে সবাই নিজের স্বার্থের পেছনেই ছুটছে। তুই যে স্বপ্ন দেখেছিলি, যে ন্যায়ের জন্য মরেছিলি, সেটা কি সত্যিই কোনো পরিবর্তন এনেছে?’
হাসেম হাসল, সেই পুরোনো হাসি, তাতে কষ্ট আর মায়ার ছায়া।
-‘তুই ঠিক বলেছিস। আমি ভেবেছিলাম, আমার মৃত্যুতে অনেক কিছু বদলাবে। কিন্তু দেখ, ১৭ বছর পরও তুই এই একই প্রশ্ন করছিস। মানে, বদলটা হয়নি। হয়তো মানুষ আসলে বদলাতে চায় না, শুধু একটা ভালো গল্প শুনতে চায়।’
তার কথা শুনে মনে হলো, সত্যিই তো, মানুষ কি কখনো বদলায়? আমরা প্রতিবাদ করি, স্বপ্ন দেখি, তারপর ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নকেই ভুলে যাই।
-‘তাহলে, তোর মনে হয় আমাদের সব চেষ্টা বৃথা?’
হাসেম মাথা নাড়ল।
-‘না, বৃথা না। কারণ, কিছু মানুষ সত্যিই বদলায়। তোর মতো কেউ কেউ হয়তো এখনো ভাবছে, প্রশ্ন করছে। সেটা তো একটা বড় ব্যাপার, তাই না?’
তার কথায় একটু আশ্বাস পেলাম।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম ‘তুই কি থাকবি আমার সঙ্গে?’
হাসেম ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে লাগল।
-‘তুই ভালো হয়ে যা, হারুন। জীবন নিয়ে ভাবিস, কিন্তু তাতে আটকে যাস না। কারণ, জীবন তো শুধু প্রশ্ন করার জন্য না, কিছু উত্তর খোঁজার জন্য।’
বলেই সে মিলিয়ে গেল। ঘরের ভেতর আবার নিস্তব্ধতা। জানালার বাইরে বিকেলের আলো মরে আসছে। হয়তো জীবন সত্যিই একটা দীর্ঘ প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমাদের দিন কেটে যায়…
আপনার মতামত লিখুন :