সংকটে কৃষির ভবিষ্যৎ

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ০৪:৪৭ পিএম

সংকটে কৃষির ভবিষ্যৎ

ছবি: সৌজন্য

বাংলাদেশ; সবুজ-সোনালি মোড়কে মোড়ানো নদীমাতৃক একটি দেশ। এ দেশে মাঠের পর মাঠজুড়ে ছড়িয়ে আছে কৃষকের হাতের ছোঁয়ায় উর্বর মাটিতে জন্ম নেওয়া ফসল। ভোরের শিশির স্নাত শস্যের পাতা, মাঠের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু আলপথ আর খেতে দুলে ওঠা সবুজ ঢেউ; সব মিলিয়ে এ এক সোনালি স্বপ্নের দেশ।

কৃষকের ঘামে যে ফসলের জন্ম, তা শুধু তার পরিবারের আহার নয়, পুরো দেশের খাদ্য ভান্ডার পূর্ণ করে। সূর্য ওঠার আগেই মাঠে নেমে পড়েন কৃষকেরা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা; সব ঋতুতে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট থাকে তাদের। আগলে রাখেন খেত, সন্তানের মতো যত্ন নেন ফসলের। অথচ, ফসল কাটার পর সেই কৃষকের মুখে আদৌ কী হাসি দেখা যায়? কৃষকেরা ফসল ফলান, কিন্তু সেই ফসলের প্রকৃত মূল্য কি তারা পান? উত্তরটা হতাশার। গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার শিক্ষিত কৃষক মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে এই বাস্তবতা অনুভব করছেন। তার কথায়, ‘সারা দিন পরিশ্রম করে আমরা ফসল ফলাই, কিন্তু যখন বাজারে বিক্রি করতে যাই, তখন দেখি লাভ তো দূরের কথা, অনেক সময় খরচই ওঠে না।’

মিজানুর রহমান মরিচ চাষে এবার ভালো ফলন পেয়েছেন। জমিতে মরিচের ঝাঁক দেখে তার মনে হয়েছিল, এবার ভালো দাম পাবেন। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখলেন, আশানুরূপ দাম নেই। তিনি বলেন, ‘কৃষিকাজ করে যদি খরচই না ওঠে, তাহলে আমরা টিকব কীভাবে? সার, বীজ, শ্রমিকের মজুরি, সেচ সব মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়। এখন মরিচ বিক্রি করে সেই খরচ তুলতে পারছি না।’

মিজানুর রহমানের মতো হাজারও কৃষক বছরের পর বছর এই একই দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছেন। উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। সারের দাম, বীজের দাম, কীটনাশকের দাম, সেচের খরচ; সবকিছুই আকাশচুম্বী। অথচ বাজারে ফসলের দাম পড়ে যায়।

এ ছাড়া রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। যে কৃষক সারা বছর পরিশ্রম করে ধান ফলান, তিনি দাম পান না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ফসল কিনে নিয়ে শহরের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে কয়েকগুণ বেশি লাভ করেন। ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক, অথচ বাজারে সেই ফসলের দাম বেড়ে যায়। এর পুরো সুবিধা নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক কৃষক কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সার, বীজ, যাতায়াত, সেচের খরচ বেড়ে চলেছে, কিন্তু উৎপাদিত ফসলের দাম কম। অনেকে বাধ্য হয়ে কৃষিজীবী ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। মিজানুর রহমানের আফসোস, ‘আগে আমাদের গ্রামে প্রায় সবাই চাষাবাদ করত। এখন অনেকেই শহরে গিয়ে দিনমজুরি করে। কারণ কৃষিকাজে টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে।’

কৃষকের স্বপ্ন বাঁচাতে কী করা উচিত?
কৃষি শুধু জীবিকা নয়, এটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু যদি কৃষক না থাকেন, তাহলে কৃষিও থাকবে না। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি সরকারি কেনাকাটার ব্যবস্থা চালু করা দরকার। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।
এ ছাড়া, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে একটি স্বয়ংক্রিয় নীতিমালা থাকা দরকার, যাতে কৃষকরা আগেভাগেই জানতে পারেন, তারা ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন।

বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এখনো কৃষি। কৃষকেরা যদি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাহলে কৃষির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। খাদ্য উৎপাদন কমলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা গোটা দেশকেই বিপদে ফেলবে। তাই কৃষকের প্রতি ন্যায্যতা নিশ্চিত করা মানে দেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।

সবুজের সমারোহে ভরা বাংলাদেশের কৃষকেরা আজ সংকটে। তাদের ঘামঝরা পরিশ্রমের যথাযথ মর্যাদা দিতে হলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোই হোক উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি। কৃষক বাঁচলে, দেশ বাঁচবে।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!