একটি ঐতিহ্যবাহী বাহনের গল্প

জুয়েল হাসান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫, ০৩:১৪ পিএম

একটি ঐতিহ্যবাহী বাহনের গল্প

ছবি: সংগৃহীত

‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে, ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু সানাই বাজিয়ে যাব তোমায় শ্বশুরবাড়ি নিয়ে।’ গরুর গাড়ি নিয়ে খুব জনপ্রিয় একটি গান। ‘আঁখিমিলন’ সিনেমায় গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন ইলিয়াছ কাঞ্চন ও সুচরিতা। প্রয়াত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে গানটি গেয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর ও সামিনা চৌধুরী।

ঐতিহ্যের বাহন গরুর গাড়ি নিয়েই আজকের এই লেখা। চলুন কিছু সময়ের জন্য ফিরে তাকাই দূরের অতীতে।
গ্রাম-বাংলার চিত্র নিয়ে যদি একটা ছবি আঁকা হয় মনের মাঝে, তাতে অবশ্যই গরুর গাড়ি বাদ যাবে না। এই গাড়ি কেবল একটা বাহনই ছিল না, একসময় এটি ছিল গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সহজ-সরল জীবনের প্রতীক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধীরে ধীরে যান্ত্রিক যুগের আগমনে ঐতিহ্যবাহী এই বাহন বিলুপ্তির পথে।

তবে, গ্রাম-বাংলার স্মৃতিচারণে দেশীয় সংস্কৃতিতে গরুর গাড়ি এখনো একটি স্নেহের সঙ্গী। গরুর গাড়ির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সিন্ধু সভ্যতা থেকেই গরুর গাড়ির ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, হরপ্পা সভ্যতায় গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল। ফ্রান্সের আল্পস পর্বতের একটি গুহায় পাওয়া ছবি থেকে ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ বছর আগেও গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হতো। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই যানটি কৃষিজাত দ্রব্য পরিবহন, যাতায়াত এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হতো।

বাংলাদেশেও গরুর গাড়ি দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষিজাত দ্রব্য, ফসল, বিয়ের বর যাত্রী নতুন বউ আনা-নেওয়াসহ অন্যান্য ভারী বস্তু পরিবহনের জন্যও গরুর গাড়ি ছিল ব্যাপক ব্যবহার। প্রাচীন এই গরুর গাড়ি কেবল যানই ছিল না, এটি ছিল গ্রামীণ জীবনযাত্রার একটি অখণ্ড অংশ। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহ, বৈশাখী উৎসব, শোকযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে গরুর গাড়ির ব্যবহার হতো। এই গরুর গাড়ি এক সময় গ্রাম-বাংলায় ছিল অবিভক্ত অংশ এবং গ্রামীণ জীবনের একটি প্রতীক। গরুর গাড়ি নিয়ে গ্রামের রাস্তায় চলা, বাজারে যাওয়া, চৈত্র সংক্রান্তি মেলায় ঘোরা ছিল এক অন্যরকম আনন্দ।

এই গাড়ি তৈরি এবং এর গঠনের কথা বলতে গেলে- গাড়ির কাঠামো তৈরিতে সাধারণত শাল, সিশম বা গামার কাঠ ব্যবহৃত হতো। এই কাঠগুলো শক্তিশালী ও টেকসই হওয়ায় গাড়ি দীর্ঘদিন চলত। গাড়ির ছাদ, দরজা ও অন্যান্য অংশ তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হতো। বাঁশ হালকা ও নমনীয় হওয়ায় গাড়িকে আরামদায়ক করে তুলত। গাড়ির চাকার উপরে হাল বা পাতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে লোহা ব্যবহৃত হতো যাতে ক্ষয় হয়ে না যায়। গরুকে গাড়ির সঙ্গে বাঁধার জন্য থাকত মজবুত রশি। দুই চাকা বিশিষ্ট এই গাড়িটি সাধারণত বলদ দ্বারা টানা হতো।

এর সামনে একটি জোয়াল থাকত, যেখানে গরুর জোত লাগানো হতো। ফসল বহন, কৃষি কাজ, মালপত্র পরিবহন, গ্রাম থেকে বাজারে যাতায়াত, বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে যাতায়াত সব কাজেই গরুর গাড়ি ব্যবহৃত হতো। গরুর গাড়ি ছিল সস্তা, পরিবেশবান্ধব, এবং যে কোনো রাস্তায় চলাচলের উপযোগী। গরুর গাড়ি একসময় বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এর ব্যবহার কমে গেছে। যদিও গরুর গাড়ির ব্যবহার কমে গেছে, তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অব্যাহত রয়েছে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!