কৃষকের কাঁধে লোকসানের বোঝা

মাহফুজার রহমান মাহফুজ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ০৪:২০ পিএম

কৃষকের কাঁধে লোকসানের বোঝা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

হেমন্তের বিদায়ের পর ঘন কুয়াশা, হিমেল হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডার দাপট ছিল চারপাশে। দিনের পর দিন দেখা মেলেনি সূর্যের। তাপমাত্রার পারদ উঠানামা করছিল ৯-১৩ ডিগ্রির ঘরে। এমন পরিস্থিতিতেও হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কৃষকেরা। জনশ্রুতি আছে ‘আশার রাজ্যে শীত আসে না’।

বুক ভরা আশা যাদের তাদের শীতে কী আর দমিয়ে রাখতে পারে? মোটেও না। এ অঞ্চলের কৃষকরাও শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে মাঠে শীতকালীন শাক-সবজি চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু কৃষকের আশার পাতে ছাই। বাজারে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের নেই চাহিদা। ফসলের দাম না থাকায় কৃষকদের বইতে হচ্ছে লোকসানের বোঝা। শুধু শাক-সবজিই নয় ধান, গম ও ভুট্টা চাষিদের মনেও জেগেছে লোকসানের ভয়।

শীতের শুরু থেকেই উপজেলা সদরের ব্রাকমোড়ের পাইকারি কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শীতকালীন শাক-সবজিতে সয়লাব কাঁচাবাজার। বাজারে প্রতি কেজি নতুন আলু ১৫-২০ টাকা, শিম ১০-১২ টাকা, বেগুন ১২-১৫ টাকা, ফুলকপি প্রতি পিচ ৩-৬ টাকা, বাঁধাকপি ৬-৮ টাকা, টমেটো ২০-২২ টাকা, মুলা ৩-৪ টাকা, ধনেপাতা ১৪-১৬ টাকা এবং প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ২০-২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

খেতে শীতকালীন শাক-সবজির ফলন ভালো হলেও বাজারে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশা কৃষকের চোখে-মুখে।
উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের ঘোগারকুটি গ্রামের কৃষক রুস্তম আলী বকসি। তিনি এবার ১৬ শতাংশ জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছেন। তিনি জানান, এই ১৬ শতাংশ জমিতে ফুলকপির ফলন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। বাজারে ফুলকপির কোনো চাহিদা না থাকায় তিনি বিক্রি করতে পারেননি। পরে জমি খালি করার জন্য পাড়া-প্রতিবেশীদের খেতের কপি মাগনা তুলে নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু তাতেও কেউ আগ্রহ দেখায়নি। অগত্যা জমিতে গরু ছাগল বেঁধে খেতের ফুলকপি খাওয়াচ্ছেন।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের চন্দ্রখানা গ্রামের কৃষক বাদশা সরকার হতাশার সুরে জানান, তিনি ২৪ শতাংশ জমিতে ১৬ হাজার টাকা খরচ করে ফুলকপি আবাদ করেছি। জমিতে ৩ হাজার ফুলকপির চারা লাগিয়েছিলেন। এরমধ্যে ৩ টাকা পিচ দরে মাত্র ২শ’ ফুলকপি বিক্রি করতে পেরেছি। খেতের অবশিষ্ট ফুলকপি কেটেকুটে খেতেই পুঁতে ফেলেছেন।

বাজারে সার, বীজ, কীটনাশক সব কিছুতেই দাম বেড়েছে। ফলে চাষাবাদে খরচও বেড়েছে অনেক। কিন্তু বাজারে আমাদের উৎপাদিত ফসলের দাম কমেছে। উৎপাদন খরচ বেশি কিন্তু উৎপাদিত ফসলের দাম নেই। তাহলে আবাদ করে লাভ হবে কীভাবে?’

পানিমাছ কুটি এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন এবার ৫ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছেন। আলুর ফলন ভালো হলেও মন খারাপ এই কৃষকের। তিনি জানান, দিন যতই যাচ্ছে বাজারে আলুর দাম ততই কমছে। এবার আলু আবাদ করে লোকসানের শঙ্কা দেখছেন তিনি।

উপজেলার বুদারবানি এলাকার কৃষক রবীন্দ্রনাথ রায়। এ বছর মরিচের আবাদ করে তারও মন ভালো নেই। বিগত বছরগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে খেতের মরিচ কিনত। এবারে বাজারে কাঁচামরিচের চাহিদা ও দাম নেই। ফলে পাইকারদের খেতের মরিচ কিনতে আগ্রহ নেই। খেতের মরিচ তুলে একই জমিতে ধান আবাদের পরিকল্পনা ছিল তার। এখন খেতের মরিচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এই কৃষক।

ধনিরাম এলাকার কৃষক আলমগীর হোসেন জানান, তিনি এবারে শীতকালীন শাক-সবজি চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শাক-সবজি ছাড়াও খেতে ভুট্টা এবং বোরো ধানের আবাদ করেছেন তিনি। শাক-সবজির মতো যদি ভুট্টা ও ধানের দরপতন হয় তাহলে জীবন-জীবিকায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।  

লোকসানের ভারে অনেকটাই বিপর্যস্ত এসব কৃষক জানান, খেতের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তারা পরিবারের খরচ জোগানোর পাশাপাশি ফলল বিক্রির টাকায় জমিতে নতুন ফসল আবাদ করেন। শাক-সবজির ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অন্য আবাদে এবার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় বাজারে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রত্যাশা করেন কৃষকেরা।

লেখক: ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!