ঢাকা শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

‘জব্বারের কারণে দেশ ছাড়িনি’: অভ্রর মেহদী

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫, ১১:৩০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’- এ স্লোগানে বাংলা ভাষার টাইপিং সফটওয়্যার ‘অভ্র’ গড়ে তোলা দলের সদস্যরা পাচ্ছেন ‘একুশে পদক-২০২৪’। এই দলের অবিসংবাদিত দলনেতা মেহদী হাসান খান। দীর্ঘদিন যাবত দেশীয় প্রযুক্তিপাড়ার গুঞ্জন যে, বাংলা ভাষার আরেক টাইপিং সফটওয়্যার ‘বিজয়’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল মেহদীকে। 

তবে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মেহদী নিজেই জানিয়েছেন যে, তার বিদেশযাত্রার সাথে মোস্তাফা জব্বারের কোনো সংশ্লিষ্টতা বা প্রভাব নেই। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে ই-মেইলে পাঠানো জবাবে মেহদী আরও জানান যে, বাজারে মনোপলির (একচ্ছত্র আধিপত্য) বাইরে যাওয়ার অনুপ্রেরণার স্লোগান ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’। রূপালী বাংলাদেশের পক্ষে সাক্ষাৎকার নেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও ইনফোটেক ইনচার্জ শাওন সোলায়মান

ইনফোটেক: মেডিকেলের শিক্ষার্থী থেকে প্রোগ্রামিংয়ে আসার পেছনের গল্পটা কী? পেশার এই রূপান্তর সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
মেহদী হাসান: মেডিকেলের ছাত্র অবস্থায় প্রোগ্রামিংয়ে আসিনি, এটা ভুল তথ্য। আমি হাই স্কুল থেকেই প্রোগ্রামিং করতাম। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার আগে পরিকল্পনা ছিল না, ডাক্তার হওয়ারই ইচ্ছা ছিল। 

মেডিকেল পাস করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শেষ করি, এর পরে পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয়। এর মধ্যে একই সাথে হাসপাতালের কাজ আর প্রোগ্রামিং দুটোই করে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। একটা সময় পরে বুঝতে পারি যে, কোনো এক দিক বেছে না নিয়ে উপায় নাই, তখন হাসপাতাল বাদ দিয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চলে আসি।

ইনফোটেক: অনেক ধরনের কথা শুনি যে, সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আপনাকে বা অভ্রকে অনেক চাপে রেখেছিল। এই কথাটা কতটুকু সত্যি? কপিরাইটজনিত অভিযোগের বাইরে মোস্তাফা জব্বার কি আর কোনোভাবে আপনাদের চাপ প্রয়োগ করেছিল? বিশেষ করে মন্ত্রী থেকে অবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু প্রয়োগ করেছিল আপনার বিরুদ্ধে?

মেহদী হাসান: কপিরাইটজনিত অভিযোগের বাইরে ওনার সাথে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। 

ইনফোটেক: বলা হয়ে থাকে, আপনি দেশ ছেড়েছেন মোস্তাফা জব্বারের কারণেই। এটা কি ঠিক বা এ বিষয়ে কী বলার আছে?

মেহদী হাসান: একদমই সত্যি না। আমি দেশেও দশ বছরের মতো বিভিন্ন স্টার্টআপে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছি। এরপর আরও বৃহৎ পরিসরের প্রজেক্টে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে আসা। সেটাই করছি এখন।

ইনফোটেক: দেশ ছেড়ে যাওয়ার পেছনে আপনার কোনো অভিমানের কারণ আছে?

মেহদী হাসান: না, প্রশ্নই ওঠে না। কারণটা ওপরে লিখেছি।

ইনফোটেক: আপনি কি মনে করেন যে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন না হলে এবং সংস্কারপন্থি অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার না এলে এই একুশে পদক আপনারা আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকারে পেতেন? হোক সে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কেউ?

মেহদী হাসান: আমার সাথে বিগত সরকার আমলেও পদকের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল। এর আগে নিয়ম ছিল পদকের জন্য আবেদন করতে হয়, আমি কখনোই আবেদন করতাম না। এবার সে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। তা ছাড়া দলগত কাজের জন্য দলকেই মূল্যায়ন করছেন তারা।

ইনফোটেক: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রবাসী মেধাবী পেশাজীবীদের আহ্বান জানিয়েছে এই সরকার। বেশ কয়েকজন প্রবাসী দেশে এসেছেনও এবং বেশ কিছু পদের দায়িত্বে কাজ করছেন। আপনাকে এমন কিছুর প্রস্তাব করা হলে রাখবেন কি না বা আপনার এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে কি না?

মেহদী হাসান: দেশের জন্য কাজ করার উপায় সবার জন্যই আছে, যার যার অবস্থান থেকে। আমি আমার অবস্থান থেকে আগে কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করার চেষ্টা করব। এ জন্য সরকারি পদ বা প্রজেক্ট আবশ্যক না। অভ্রর জন্য কাজ করা মানে আমার কাছে দেশের জন্যই কাজ করা। 

তা ছাড়া ‘পিটার প্রিন্সিপল’ (কর্মীরা নিজেদের দক্ষতার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর অযোগ্যতার স্তরে পদোন্নতি পাওয়া) বলে একটা ব্যাপার আছে। কেউ একজন ভালো সফটওয়্যার বানাচ্ছে দেখে আপনি তাকে নীতিনির্ধারক পদে বসিয়ে দিলে, সে যে ওইখানেও ভালো কাজ করতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে যেটা ভালো পারে, তার সেটাতেই ফোকাস করা উচিত।

ইনফোটেক: অভ্র নিয়ে আরও বৃহৎ পরিসরে কিছু করার ইচ্ছা আছে কি না। বিশেষ করে ‘অভ্র’ নামে স্মার্টফোনে কোনো অ্যাপস নেই। সে বিষয়ে কিছু ভাবছেন কি না? আবার এডবি (ফটোশপ, প্রিমিয়ার ইত্যাদি), কোয়ার্ক এক্সপ্রেসের মতো সফটওয়্যারে অভ্রতে লেখা ফন্ট ঠিকভাবে কাজ করে না।

মেহদী হাসান: এর থেকে বৃহৎ পরিসরে কিছু করার পরিকল্পনা নেই। মোবাইলে লেখার জন্য অন্যান্য সফটওয়্যার আছে। আবারও বলি, যে যেটা ভালো পারে, তার সেটাতেই ফোকাস করা উচিত। 

এডবির সফটওয়্যারে বাংলা লিখতে সমস্যা আগে ছিল, তার কারণ অভ্র না। এরা ঠিকমতো ইউনিকোড সাপোর্ট করত না। মানুষ এখন অভ্র দিয়ে বই প্রকাশ করে, আগের অবস্থা এখন নেই। কোয়ার্কের এখনকার অবস্থা কী আমার জানা নেই অবশ্য।

ইনফোটেক:  আপনি একুশে পদক গ্রহণ করতে কবে দেশে আসবেন?

মেহদী হাসান: এক দিনের জন্য আসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।

ইনফোটেক: অভ্র নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান জানানো যায় কি না যেমনÑ এখন পর্যন্ত অভ্রর মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কত? বা কতবার ডাউনলোড হয়েছে?

মেহদী হাসান: একই ব্যবহারারী চাইলে বারবার অভ্র ডাউনলোড করতে পারে। আবার ডাউনলোড করা ফাইল অফলাইনেও আদান-প্রদান করা হয়। আর সফটওয়্যারে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তাকে সম্মান জানিয়ে কোনো ট্র্যাকিং করি না। তাই আমাদের পক্ষে ব্যবহারকারীর সঠিক পরিসংখ্যান জানা প্রায় অসম্ভব।

ইনফোটেক: অভ্র বিনা মূল্যের হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে অন্যদের ক্ষেত্রে এটিকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরার অভিযোগ পাওয়া যায়। পুরো সফটওয়্যার দুনিয়া তো বিনা মূল্যের সফটওয়্যারে চলে না। এমন সময় অভ্রর কারণে অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোকে হেয় করা হয়। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মেহদী হাসান: অভ্র বিনা মূল্যের হওয়ার কারণ আমরা চেয়েছিলাম এটা যেন সবার সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে। কেউ যদি বাংলা সফটওয়্যার বানানো তার পেশা হিসেবে নেয় এবং সেখানে লাইসেন্সের জন্য মূল্য থাকে, সেটা একান্তই তার ব্যাপার। অভ্রর সাথে সেটার কোনো বিরোধ নেই। 

অনেকে ভাবেন, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ কমার্শিয়াল সফটওয়্যার থেকে মুক্ত সফটওয়্যার- এইটা  যাওয়ার স্লোগান। এইটা মনোপলির বাইরে যাওয়ার স্লোগান, ফ্রি না পেইড সেটা গৌণ। মানুষ ঠিক করবে তারা কী চায়, তাদের সেই সুযোগ এবং স্বাধীনতা থাকতে হবে। 

অভ্রতে টাইপ করার মতো ব্যবস্থা যে কেউ চাইলে তার সফটওয়্যারে যুক্ত করতে পারে, করেছেও তাদের নিজের উদ্যোগে (উইকিমিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মোবাইল কিবোর্ড)। এ রকম কেউ সেটা কমার্শিয়াল সফটওয়্যার হিসেবে বিতরণ করতে চাইলে সেটাও তাদের ইচ্ছা।