ভোরের আলো ফোটার আগেই রাস্তায় নেমেছিলাম। শহর তখনো ঘুমে, তবে কিছু মানুষ এরই মধ্যে বেরিয়ে পড়েছে। গতকাল ছিলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একটি দিনের স্মৃতি, আত্মত্যাগ, আর ভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। আমার গন্তব্য শহিদ মিনার। ফুল হাতে পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, কত মানুষ আজ এখানে আসবে, ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া সেই অকুতোভয় তরুণদের শ্রদ্ধা জানাতে। ১৯৫২ সালের কথা, কিন্তু ইতিহাস যেন এখনো জীবন্ত, বাতাসে মিশে আছে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের শ্বাস-প্রশ্বাস।
প্রথম প্রহরে শহিদ মিনারের সামনে পৌঁছাই। চারপাশ নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মাঝেও একটা গভীর সুর বেজে চলেছে, এই সুর জাতির হৃৎস্পন্দন। ফটক পেড়িয়ে সামনে সারি সারি জুতা রাখা, পা খুলে সবাই শ্রদ্ধায় নত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। একেকজন একেকভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কেউ ফুল দিয়ে, কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ বা মিনারের পিলারের গায়ে হাত রেখে যেন অনুভব করতে চাইছে ইতিহাসের সেই স্পর্শ।
এক বৃদ্ধকে দেখি ধীরে ধীরে হাঁটছেন। হাতে একটি কালো-সাদা ছবি। ছবিটা কার, বুঝতে পারলাম না। তিনি মিনারের সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। চোখ দুটি বন্ধ করলেন, ঠোঁট কাঁপছ। মনে হলো, কোনো নাম ফিসফিস করে বলছেন। হয়তো তার কোনো বন্ধু অথবা সহযোদ্ধা; যার রক্তে এই মিনারের পথ রাঙা হয়েছিল।
একটা কোণে কয়েকজন শিশু তাদের মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক মা নিচু স্বরে বলছেন, ‘এখানে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বীরদের প্রতি সম্মান জানানো হচ্ছে। তাদের জন্য দোয়া কর।’ শিশুরা বোঝে কি না জানি না, কিন্তু তাদের চোখে গভীর কৌতূহল। এই ছোট ছোট কণ্ঠগুলোই তো একদিন ভাষার বর্ণমালা ধরে রাখবে।
একদল তরুণ গান ধরেছে-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি...’
তাদের কণ্ঠে এক অদ্ভুত শক্তি। মনে হলো, ইতিহাসের সেই সুর আজও এই আকাশে-বাতাসে বাজছে। ভাষার জন্য জীবন দেওয়া মানুষগুলো এই সুরের মধ্যে এখনো বেঁচে আছে।
এক পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আঁকছে। খেয়াল করলাম, তার স্কেচবুকে শহিদ মিনারের ছবি ফুটে উঠছে। কোনো লাইন পরিপূর্ণ না, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে সে কী আঁকতে চাইছে। কিছু দৃশ্য ভাষায় ধরা যায় না, কেবল তুলির রেখায় বন্দি করা যায়।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ এক তরুণ এসে পাশে দাঁড়াল। সে নিচু স্বরে বলল, ‘ভাষাটা পেয়েছি ঠিকই, আমরা কি ঠিকমতো তা ধরে রাখতে পারছি?’ কথাটা শুনে মনে হলো, শহিদদের আত্মত্যাগ শুধু ইতিহাসের গল্প হয়ে যাচ্ছে না তো? ভাষাকে কি আমরা ঠিকমতো ভালোবাসতে শিখেছি?
শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে মনে আবারও হলো, এই জায়গাটা শুধু ইট-পাথরের মিনার নয়, এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আমরা ভাষার জন্য লড়াই করেছি, আমরা কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে এনেছি, কিন্তু সেই ভাষাকে কি যথাযথভাবে আগলে রাখতে পারছি?
সূর্য একটু উপরে উঠেছে, মিছিলের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। কালো ব্যানারে লেখা, ‘শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রতিজ্ঞা’। আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, ভাষা শুধু মুখের শব্দ নয়, এটি সংস্কৃতি, এটি পরিচয়।
বুকে এক ধরনের ভার নিয়ে শহিদ মিনারের পথ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে থাকল স্তব্ধ বাতাস, খালি পায়ের স্পর্শ, আর কিছু চিরন্তন প্রশ্ন- আমরা কি সত্যিই ভাষার ঋণ শোধ করতে পেরেছি?