সংসদ ভবনের সামনে বসে আছি, বকুল গাছে হেলান দিয়ে। সন্ধ্যা নামছে, বাতাসে একটা পুরোনো কাগজ উড়ে এসে পায়ের কাছে থামে। ছেঁড়া, বিবর্ণ, অনেকটা সময়ের মতো। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করেছে। আলোর নিচে ছায়ারা লম্বা হয়ে পড়ছে। এখানে বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি আছে, আবার আছে একটা অস্বস্তিও। এখানে বসলেই আমার মনে হয় যেন গোটা দেশটাই একটা বিশাল নাট্যমঞ্চ, আর আমরা সবাই শুধু দর্শক।
সামনের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে চলে গেল।
আমি বিভ্রমের মতো দেখতে পাই, সংসদের ভেতরে আলো জ্বলছে, কেউ হয়তো আজকের মিটিং শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, কেউ হয়তো দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছে; অথবা ক্ষমতা নিয়ে হিসাব-নিকাশ। আমি হেলানটা একটু নিচু করি, মাথাটা ঠেকাই ইটের দেয়ালে। রাজনীতির গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত লাগে, অথচ এই ক্লান্তির শেষও নেই।
পেছন থেকে কয়েকটা কণ্ঠ শুনতে পাই। কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে তর্ক করছে।
একজন বলছে, ‘রাজনীতি আসলে কী, বল ত ? ক্ষমতার খেলা, তাই না?’
আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে কথার খেই ধরছে ‘ক্ষমতা মানে দায়িত্ব। কিন্তু এখন দায়িত্ব বলে কিছু নেই।’
প্রথমজন বলল, ‘সবাই যদি দায়িত্বহীন হয়, তাহলে দেশটা চলবে কীভাবে?’
আমি চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকি। এই কথাগুলো কতবার কতভাবে শুনেছি! এত পুরোনো যে মনে হয়, বাতাসেও এগুলো মিশে গেছে। শুধু মানুষ বদলায়, গল্প বদলায় না।
একটা পাখি উড়ে এসে মাথার ওপর গাছের ডালে বসে। কিছুক্ষণ মাথা কাত করে তাকিয়ে থাকে, তারপর ডাক দেয়। আমি জানি না, ওটা স্বস্তির ডাক, নাকি ব্যঙ্গের।
একটা হেডলাইট চোখে এসে পড়ে, আমি একটু সরে বসি। একটা রিকশা সামনে দিয়ে চলে যায়, মাঝবয়সি চালক ক্লান্ত মুখে প্যাডেল চেপে যাচ্ছে। তার জন্য সংসদ ভবনের আলো আর নিভে থাকা বাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তার জীবনে আলো নিভেই আছে।
আমি উঠে দাঁড়াই। আজকের রাতটা হয়তো সংসদের আলোয় আলোকিত থাকবে, কিন্তু অন্ধকার রয়ে যাবে ঠিক আগের মতোই।
আপনার মতামত লিখুন :