ঢাকা রবিবার, ০৯ মার্চ, ২০২৫

কেমন হলো বইমেলা

আরফান হোসাইন রাফি
প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৫, ০৫:৪৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পর প্রথমবার বইমেলা। বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী আয়োজন হয়েছে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন এই মেলা। লেখক এবং পাঠকের বৃহত্তম এই মিলন উৎসবকে ঘিরে এ বছর সবার মাঝেই ছিল আলাদা উত্তেজনা। তবে শেষ পর্যন্ত কেমন হলো বইমেলা? এই নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন জনপ্রিয় লেখক এবং প্রকাশকরা। তুলে ধরেছেন আরফান হোসাইন রাফি

 

পাঁচ মিশালি বইমেলা

সাদাত হোসাইন (কথাসাহিত্যিক)

ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে এবারের বইমেলা অগোছালো মনে হয়েছে। বইমেলায় একটা বিশেষায়িত ব্যাপার থাকবে, বইয়ের স্টল থাকবে। কিন্তু বইমেলায় প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে সারা মেলায় শুধু হকারদেরই দেখতে পেয়েছি। নারিকেল বিক্রেতা, চিড়া বিক্রেতা, কাঁচা আম বিক্রেতা, পেয়ারা বিক্রেতাদের ভিড়ে বইমেলা শেষ অবধি আর বইমেলা থাকেনি। এই বিষয়টা খুব হতাশ করেছে। বইমেলায় সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই অগোছালো ছিল। এমন অগোছালো বইমেলা আমি আগে দেখিনি! আর বই বিক্রির ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য না পেলেও বোঝা গেছে যে, সার্বিকভাবে বই বিক্রির সংখ্যা অনেক কমেছে। তবে আমার বই বিক্রি আশানুরূপ ছিল। আগামী বইমেলায়  প্রত্যাশা একটাই থাকবে যে, বইমেলা যেন পাঠকবান্ধব হয়। অগোছালো ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক করতে হবে যেন পাঠকরা আরাম করে ঘুরেফিরে বই দেখতে পারেন। বাণিজ্যমেলায় তো অনেক কিছু রয়েছেই। বইমেলাটা না হয় শুধু পাঠক আর বইপ্রেমীদেরই থাকুক। এটাকে পাঁচ মিশালি মেলা করার কোনো মানে হয় না!

 

একটু মন্দাভাব দেখা গেছে

মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন (লেখক ও প্রকাশক)

এবারের বইমেলা জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম মেলা। টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আগেরবারের তুলনায় একটু মন্দাভাব দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা খুব খারাপ থাকে, সেজন্যে নারী পাঠকের উপস্থিতি ৭টার পর কম দেখা গেছে। তা ছাড়া ৩টি শুক্রবারের ছুটি মার খেয়ে গেছে। এগুলোই মূলত মেলা মন্দা হওয়ার কারণ। তবে আমার কাছে মনে হয় আরেকটি কারণও গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো পাঠকের কাছে আগ্রহ জাগানিয়া কন্টেন্টের উপস্থিতিও কম ছিল। প্রকাশকরা যদি এ যুগের পাঠকের রুচি এবং ঝোঁক বুঝতে না পারে তাহলে দিন দিন মেলার জৌলুস কমবে। আমি লক্ষ্য করেছি, বেশিরভাগ লেখক-প্রকাশক মেলার বেচা-বিক্রি কম হওয়ার জন্য পাঠককে দায়ী করেছে। এটা সম্ভবত ভুল। আসলে পাঠকের কাছে মানসম্মত এবং আগ্রহ জাগানিয়া লেখা কমই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা যদি ধরে নেই, মেলায় পাঠক আসবে আর কোনো না কোনো বই কিনে বাড়ি ফিরে যাবে, তাহলে ভুল করব। পাঠককে মানসম্মত কন্টেন্ট উপহার দিতে না পারলে তারা কেন পকেটের টাকা খরচ করে বই কিনবে? সেই টাকা দিয়ে বরং খাবার-দাবার কিনে খাবে। এটাই স্বাভাবিক।


বই মেলার চরিত্রটা এ রকমই

লুৎফর হাসান (কথাসাহিত্যিক)

এবারের বইমেলা জমজমাট হয়ে উঠেছিল শেষের দিকে। এখন অনেকেই বইমেলায় নতুন যায়, তারা গিয়ে নানান মন্তব্য করে। আমরা তো বইমেলায় যাচ্ছি আজকে ১৭-১৮ বছর ধরে। বইমেলার চরিত্রটা এ রকমই; শেষ ১০ দিনে বইমেলা মূলত জমে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর বই বিক্রির ব্যাপারটা হচ্ছে যে, মানুষ বেতন পায় ১০ তারিখের পর। বাড়ি ভাড়া হোক বা অন্যান্য খরচ সবকিছুই ১০ তারিখের পর। তাই স্বাভাবিকভাবেই মাসব্যাপী বই কেনার যে ব্যাপারটা এটা চোখে পড়ে ১০ তারিখের পরে। আর যেহেতু ১৩-১৪ তারিখ পহেলা ফাল্গুন, তাই বইমেলা সেসময় জমে। এটা বলার কিছু নেই যে, শুরুর দিকে বইমেলা কেমন ম্যাড়মেড়ে দেখা যাচ্ছে! এটা তারা বলে, বইমেলা সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান যাদের নেই। আরেকটা কথা হচ্ছে, গত বছর বা অন্য বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য তেমন বই এ বছর আসেনি। জুলাই আগস্টের পর আমাদের সবার মনে এবং সৃজনশীলতায় একটা প্রভাব পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। অনেকেই হয়তো পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে ঠিকঠাক মতো বই জমা দিতে পারেনি, বই আসেনি। আমি মনে করি যে, এটা সাময়িক একটা ক্রাইসিস, আগামী বছর থেকে হয়তো বা বইমেলা তার নিজস্ব চেহারায় ফিরবে। যারা হতাশ তারা সবকিছুতেই হতাশ, যারা আশাবাদী তারা সবকিছুতেই আশাবাদী। আমি আশাবাদী, আমি স্বপ্নের পক্ষে। আমি মনে করি যে বইমেলা একসময়  ঠিকঠাক তার চেহারা ফিরে পাবে।

 

কিছুটা ম্লান ছিল

ইশতিয়াক আহমেদ (কথাসাহিত্যিক)

এবারের বইমেলাটা দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্যবারের তুলনায় কিছুটা ম্লান ছিল। মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করেছে। মাঝখানে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা অনেক মানুষকে বইমেলা বিমুখ করে দিয়েছে। একুশ থেকে আটাশ পর্যন্ত মূলত বইয়ের ক্রেতা বা পাঠকরা মেলায় যায়। সেই অনুযায়ী ক্রেতা খুব কম ছিল। বইমেলা আসলে বইমেলার মতোই হওয়া উচিত। এবার কিছু বড় প্রকাশক বা যাদের সত্যিকার অর্থে বেশি বই তারা প্যাভিলিয়ন পায়নি। দশজন প্রকাশকের নাম বললে যাদের নাম আসবে তাদের আসলে প্যাভিলিয়ন বঞ্চিত করা ঠিক না! এতে প্রকাশক এবং লেখকদেরও এক ধরনের অনাগ্রহ তৈরি হয়। এ ছাড়া এই বইমেলায় হকার এবং অনুপ্রবেশকারীরা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না। এতে পাঠকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আগামী মেলাগুলোতে এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে সমাধান করবে এমনটাই প্রত্যাশা।

 

আশানুরূপ হয়নি

মো. মাশফিকউল্লাহ তন্ময় (প্রকাশক, স্টুডেন্ট ওয়েজ)

এবারের বইমেলা খুব একটা ভালো ছিল না! প্রথমে যেরকমটা আশা করেছিলাম সেরকমটা হয়নি। বাংলা একাডেমি এবার খুব একটা খেয়াল করেনি। সিকিউরিটি, হকার এগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। ফলে বিশৃঙ্খল একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাটে বিভিন্ন গন্ডগলে পাঠকদের বইমেলায় আসতে সমস্যা হয়েছে। তাই, গতবারের তুলনায় বই বিক্রি কমেছে  ৩০%-এর মতো। আগামীতে প্রত্যাশা থাকবে যেন সুন্দর করে গুছিয়ে বইমেলা আয়োজন করা হয়।