সমাজের নিয়ম, কুসংস্কার, কিংবা শারীরিক সীমাবদ্ধতা; কোনো কিছুই একজন নারীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে রাখতে পারে না, যদি তার মনে থাকে অদম্য সাহস। ইতিহাসজুড়ে এমন অনেক নারী আছেন, যারা প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, নতুন পথ দেখিয়েছেন। তেমনই একজন নারী ছিলেন অ্যানি কোহেন কপচভস্কি, যিনি পরে পরিচিত হন অ্যানি লন্ডনডেরি নামে। তিনি এমন একজন নারী, যিনি একাই সাইকেলে চড়ে বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন, যখন সমাজ মনে করত, মেয়েদের পক্ষে সাইকেল চালানোই অসম্ভব!
১৮৯৪ সালে বোস্টনের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি বাজি ধরেছিলেন, একজন নারী কখনোই সাইকেলে চড়ে বিশ্বভ্রমণ করতে পারবে না। যদি কেউ পারেন, তবে তাকে দেওয়া হবে ১০ হাজার ডলার। চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন ২৩ বছর বয়সী অ্যানি কোহেন কপচভস্কি। এখানে সমস্যা হলো, অ্যানি জীবনে কখনো সাইকেল চালাননি! কিন্তু তাতে কী? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বিশ্বভ্রমণে বের হবেন এবং প্রমাণ করবেন, একজন নারীর পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
২৭ জুন ১৮৯৪ সালে বোস্টন থেকে সাইকেলে চেপে রওনা দেন অ্যানি। সঙ্গে ছিল কয়েকটি পোশাক আর আত্মরক্ষার জন্য একটি মুক্তাখচিত পিস্তল। এ ভ্রমণের সম্পূর্ণ খরচ তাকেই ওঠাতে হবে। তাই ঠিক করলেন, নিউ হ্যাম্পশায়ারের লন্ডনডেরি লিথিয়া স্প্রিং ওয়াটার কোম্পানির পোস্টার তার বাইসাইকেলে লাগিয়ে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করবেন, বিনিময়ে পাবেন ১০০ ডলার। অনেকটা এখনকার দিনে ক্রিকেটারদের ব্যাটে নির্দিষ্ট কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে খেলার মতো। কিন্তু সে সময়ে এভাবে বিজ্ঞাপনের ধারণা অ্যানিই প্রথম প্রচলন করেছিলেন। এমনকি সাইকেলটাও কলম্বিয়া বাইসাইকেল কোম্পানি থেকে নিয়েছিলেন। সে সময় মেয়েরা সাধারণত স্কার্ট পরত, যা সাইকেল চালানোর জন্য খুবই অসুবিধাজনক ছিল। ভালো রাস্তা পেলে প্রতিদিন আট-দশ মাইল চলতে পারতেন। কখনো রাস্তার ধারে ছোট রেস্তোরাঁয় খেতেন, কখনো কোনো সরাইখানায় রাত কাটাতেন। তবে যেখানেই যেতেন, তাকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত, একজন নারী সাইকেল চালাচ্ছে! যা তারা কখনো কল্পনা করেনি।
শিকাগো পৌঁছাতে পৌঁছাতে শীত চলে এলো। সান ফ্রানসিস্কোর বিশাল পাহাড় তখন সাইকেলে চেপে পার হওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। নতুন স্পনসর পেলেন স্টার্লিং সাইকেল ওয়ার্কস কোম্পানির, যারা তাকে হালকা একটি নতুন সাইকেল দিলো। এবার তিনি পোশাক পরিবর্তন করে ট্রাউজার ও হালকা জামা পরেন, যা তখনকার সমাজের জন্য ছিল বেশ সাহসী একটি সিদ্ধান্ত। নতুন উদ্যমে আবার রওনা দিলেন নিউইয়র্ক থেকে ফ্রেঞ্চ জাহাজে চড়ে ফ্রান্সের উত্তর উপক‚লের দিকে। কিন্তু ফ্রান্সে পৌঁছানোর পরই বিপত্তি বাধল। প্রশাসন তার সাইকেল জব্দ করল, টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়া হলো, এমনকি সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবেদনও ছাপা হলো। কিন্তু তিনি দমে যাননি। বিভিন্ন উপায়ে প্যারিস থেকে মার্শেই চলে গেলেন, তারপর সেখান থেকে আলেকজান্দ্রিয়া, কলম্বো, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান; এভাবেই চলতে থাকল তার যাত্রা।
১৮৯৫-এর মার্চে জাহাজে চেপে জাপানের ইয়োকোহামা থেকে সান ফ্রানসিস্কো পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে আবার সাইকেলে লস অ্যাঞ্জেলেস, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে এল পাসো চলে আসেন। এল পাসো থেকে উত্তরে আলবুকার্ক, ডেনভার, নেব্রাস্কা পাড়ি দেন। কখনো সাইকেলে, কখনো ট্রেনে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আবার শিকাগো পৌঁছান অ্যানি। সেখান থেকে পুরস্কারের ১০ হাজার ডলার বুঝে নিয়ে প্রায় ১৫ মাস বাদে বোস্টনে নিজের বাড়িতে ফেরেন। ততদিনে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়ে গেছেন। সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নিতে আসতে শুরু করলেন, মানুষজন জানতে চাইল তার অবিশ্বাস্য ভ্রমণের গল্প। যাত্রাপথে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হন। শোনা যায়, একবার দুর্ঘটনায় পড়ে তার এক পা মারাত্মকভাবে জখম হয়। কিন্তু তাতেও তিনি থামেননি। এক পা দিয়েই সাইকেল চালিয়ে পথ পাড়ি দিয়েছেন! আবার একবার ভারতে এক বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, জাপানে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য জানা যায়, এসব গল্পে তিনি নিজে একটু রং চড়িয়েছিলেন, তবে এতে তার প্রকৃত কৃতিত্ব এতটুকুও কমে না।
এরপর অ্যানি লন্ডনডেরি হয়েছিলেন নারীর শক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সমাজ যতই বাধা দিক, সাহস থাকলে নারীরা সবকিছু করতে পারে। আজকের নারী দিবসে তার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য সাহস আর আত্মবিশ্বাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নারীর অগ্রযাত্রা কেউ আটকাতে পারে না; শুধু দরকার নিজেকে প্রমাণের ইচ্ছাশক্তি।