ঢাকা রবিবার, ০৯ মার্চ, ২০২৫

একটি রেল ভ্রমণের ঘণ্টালিপি

মো. ইয়ামিন আলম রোহান
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৫, ০৫:৫২ পিএম
ছবি: সৌজন্য

চৈত্রের শেষ ধরে বৈশাখ মাসে রোজা পড়েছে এবার। দিন কয়েক গরমে কাটালাম এখন আবার ক্ষণিক পর পর প্রকৃতি কেমন যেন এই গরম, এই কিঞ্চিৎ ঠান্ডা আবার এই ঝড়ো হাওয়া, এই বৃষ্টি— ইলশেগুঁড়ি নয়তো মুষলধারে ঝড়ছে। এদিকে মাগফিরাতের শেষ দিনে ডাক পড়েছে বোনকে নাইওর আনার। তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে, সে দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। এতে আমি প্রথমে কিঞ্চিৎ সিদ্ধান্তহীনতায় পড়লেও পরে ঠিক করলাম যাবই।

অনেকদিন হয়েছে পাহাড়ে চড়া হয় না, সমুদ্র দেখা হয় না। বোনকে আনতে গিয়ে যদি সে সুযোগ কপালে জুটে, তাহলে তো ভালোই হয়। সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম রেলে যাওয়ার। গাজীপুর থেকে যেতে হবে চট্টগ্রাম। গত রাতে ইন্টারনেট থেকে টিকিট কেটেছি— স্নিগ্ধা শ্রেণির টিকিট। রেল ছাড়বে ৭টা ৪৫ মিনিটে, ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে রেল ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সুবাদে সেহরি খেয়ে ফজর নামাজ পড়ে রওনা হলাম রেল ধরার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম স্টেশনে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে; কিন্তু সে ভাবনা ক্ষান্ত গেল!

অনেক আগেই চলে এসেছি— কমপক্ষে ঘণ্টা দুই! স্টেশনে ঢুকেই ঈদে বাড়ি ফেরার মানুষদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করলাম। সব ঠেলে পৌঁছালাম স্টেশনের বিশ্রামাগারে— ফার্স্ট ক্লাস বিশ্রামাগার। ভেতরে প্রবেশেই খেয়াল করলাম একপ্রান্তে টয়লেটে যাওয়ার মানুষের অপেক্ষা। সেই লাইনে আমিও দাঁড়ালাম— সেহরিতে পানি আজ বেশি পান করা হয়েছে আর সেটারই ফলস্বরূপ এই অবস্থা! দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের টয়লেটে যেতে হলো; তা ছাড়া উপায় ছিল না। তো যাই হোক, কাজ সেরে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এলাম; কত শত মানুষ। গুটিকতক কর্মক্ষম মানুষ এদিক-সেদিক ছিটিয়ে, ওরা স্টেশনেই থাকে!

আমি পকেট থেকে আমার স্মার্টফোন বের করে বেশকিছু ফটোগ্রাফি করলাম; একবার দুইবার প্ল্যাটফর্মের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত পায়চারী চলল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কতগুলো রেলগাড়ি এলো-গেল। আমি বসে বসে কিছুক্ষণ আবোলতাবোল ভাবছি আবার ক্ষণিক পর পর রেলের সময়সূচি দেখছি; প্ল্যাটফর্মের এক একটা রেল চলে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন এই বুঝি আমায় রেখে গেল ‘মহানগর প্রভাতী’! কিন্তু সেই ভাবনা ক্ষণে ক্ষণেই ক্ষান্ত যাচ্ছে।

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ঠেলে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত রেল এলো; চড়ে বসলুম। সময়মতো ছেড়েও দিল। ঝকঝক শব্দে আস্তে আস্তে গতি বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহুরে পরিবেশ ছেড়ে জানালার বাইরে সবুজ গাছপালা দেখা শুরু করলাম। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘুম এসে গেল চোখে; ঘুম ভেঙে দেখি মস্ত সময় কেটে গেছে। উঠে ট্রেনের টয়েলেটে গিয়ে খানিক ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

এবার আমার ব্যাগ থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস বের করে পড়া শুরু করলাম। আমি সব ভ্রমণেই ব্যাগে গুজে আর কিছু না নিলেও গল্প-উপন্যাসের বই নিয়ে নেই। যাক সেই প্রয়াসেই ‘আরণ্যক উপন্যাসের পাতা উল্টে উল্টে যখন মন হারিয়েছিল গহীন অরণ্যে তখনই ট্রেনের গতি কমতে থাকল; বাইরেও সবুজ আরণ্য ছোয়া! রেল থামলে বুঝতে পারলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে আছি।

নিমিষেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে ডজন কয়েক লোক হুড়মুড় করে উঠে খালি সিটগুলো ভরাট করে ফেলল; দু-চারজন আবার দাঁড়িয়েছেও। জন কয়েক লোক তো রীতিমতো কি নিয়ে যেন ঝগড়া পাতিয়েছে। আসলে ওরা সবাই বিনা টিকিটে উঠেছে, হয়তো পরের স্টেশন কিংবা তারপরেরটায় নামবে। রেল আবার চলল। ততক্ষণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে গরম হাওয়া বইছে; লোকগুলো নামার পরে অবশ্য আবার ঠান্ডা হতে বেশি সময় লাগেনি।

হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখছি প্রকৃতির অপরূপ রূপ! জানালার বাইরে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ; ফসলের খেত! দূরে জায়গায় জায়গায় গুটিকয়েক লোক, ওদের দেখে মনে হচ্ছে যেন পিপীলিকার কলোনি। ফাঁকে ফাঁকে মাঠে চষছে গরু-মহিষের পাল। কৃষক ধান কাটায় মজেছে; কেউ মাথায় করে ধানের বোঝা চেপে যেন হাঁটছে অজানা পথের ঠিকানায়! আকাশে কালবৈশাখীর মেঘের ঘনঘটা; কখনো বেশি কখনো কম! বিস্তর ফসলের মাঠে কোথাও সোনালি ধান, কোথাও সবুজ! মাঝে মাঝে টিনের দুইচালা কিছু ঘরে সূর্যিমামার কিরণ ঝড়ছে; সেকি অপরূপ দৃশ্য!

হঠাৎ রেল ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। রেলপথ ঘেঁষেই বিদ্যুতের লাইন, যান সড়ক, মানুষের ঘরবাড়ি, দোকান, ডোবা, গাছের আইল, থেমে থেমে উন্নয়ন কাজ চলমান রেলের ব্রিজ— নতুন পথ। রেলের বগিতে অর্ধশতক মানুষ বসেছে। কেউ ঝিমাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে, কেউ মুঠোফোনে কথা বলছে, কেউ বিভোর গভীর ভাবনায়, কেউ আবার সংবাদ দেখছে, কেউ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে, দুইচার জোড়া মানুষ মেতেছে খোশগল্পে, আবার আমার মতো কিছু বাচ্চা ছেলেপেলে বাইরের দিগন্তপ্রসারী দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত! ঝকঝক করে রেল চলছে, স্টেশনে স্টেশনে থামছে! আপেক্ষিকতা থেমে নেই, জগতের অন্যসবের মতো রেলের ভেতর বাহির অন্যসাপেক্ষ!

১০ বৈশাখ, ১৪২৯