ঢাকা সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫

ইথারের

হাইওয়ে যাত্রা

মির্জা হাসান মাহমুদ
প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম
ছবি: সৌজন্য

স্বপ্নহীন জীবন যেন এক থেমে থাকা গাড়ি, যার গন্তব্য নেই; যার চলার নেই কোনো গতি। কিন্তু কিছু গাড়ি থাকে, যারা নিজেরাই হয়ে ওঠে হাইওয়ে, তৈরি করে নিজের পথ, আর ছুটে চলে অনিশ্চিতের দিকে। ঠিক সেরকমই এক ভ্রমণের  নাম ‘হাইওয়ে’। হাইওয়ে একটি এমন ব্যান্ড; যা পথের মতোই অস্থির, বহমান, এবং রহস্যময়। এই ব্যান্ডের গানের ভেতর আছে এক ধরনের ঘোর, যা শ্রোতাকে বাস্তবতা আর অবচেতনের মাঝখানে আটকে রাখে। সাইকেডেলিক রক ঘরানায় কাজ করা এ ব্যান্ডের গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর যেন একেকটি স্টেশন, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে পায় নিজের প্রতিচ্ছবি। ব্যান্ডের খুটিনাটি নিয়েই দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যান্ডটির ফ্রন্টম্যান হাসান ইথার। আর তা তুলে ধরেছেন - মির্জা হাসান মাহমুদ

 

চড়াই-উতরাই পেরিয়ে:

হাইওয়ে ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘অবস্থান’ গান দিয়ে। তখন ব্যান্ড বলতে শুধু ইথার একাই ছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বন্ধুদের মধ্যে থেকে ব্যান্ডের নতুন সদস্যরা যোগ দিতে শুরু করে। স্যাম ড্রামসে, ঈশমাম গিটারে, নাদভী বেসে যোগ দেয়। এরপর প্রকাশিত হয় তাদের আইকনিক গান ‘ঘোড়গাড়ি’, যা ব্যান্ডের প্রথম দিকের পরিচিতি তৈরি করে। সবাই তখন বন্ধু, গান তৈরির প্রক্রিয়াটা ছিল একদম নৈমিত্তিক, মনের খেয়ালে। তবে ইথারের বন্ধু সাদ ম্যানেজার হিসেবে ব্যান্ডে যোগ দেয়ার পর বিষয়টা সিরিয়াস হয়ে ওঠে। এরপর ‘সাক্ষী’ সহ আরও কিছু গান মুক্তি পায়।

বর্তমান সময়ে শ্রোতাপ্রিয় হলেও হাইওয়ে’র পথচলা কখনোই একরকম ছিল না। হাসান ইথার জানান, কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা ব্যান্ডের ভেতরে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। ঈশমাম মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পাশাপাশি তার পিঠের একটি জটিল অপারেশন হয়, যা তাকে শোগুলোয় পারফর্ম করার জন্য আনফিট করে তোলে। এদিকে, নাদভী ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। যার ফলে পরে নতুন লাইনআপ তৈরি হয়। সামিন এবং প্রিয় গিটারে, দীপ্ত বেস, এবং ইবন কি-বোর্ডে যোগ দেয়। এ সময়েই ইথার তার সলো প্রজেক্ট থেকে ‘ছায়া’ গানটি প্রকাশ করেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে ইথার শেয়ার করেন কিছু না বলা কথা। তিনি বলেন, ব্যান্ডের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় আসে তখন, যখন হঠাৎ করে ইউটিউব থেকে ‍‍ঘোড়গাড়ি‍‍’ সহ কয়েকটি গান ডিলিট হয়ে যায়। এসময় ঈশমাম ব্যান্ড ছেড়ে দেয়। কিছুদিন পর গানগুলো আবার আপলোড করা হলেও, এ ধাক্কা ব্যান্ডের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।‍‍‍‍’

তবে খুশির খবর হলো, সমস্ত চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে হাইওয়ে। আর কথায় আছে, ‘যারা থেমে যায় না, তারা একসময় গন্তব্যে পৌঁছাবেই।’ ধাক্কা কাটিয়ে ব্যান্ড নিয়মিত স্টেজ শো করতে থাকে এবং শুরু হয় ‘মৃতদেহের গান’ অ্যালবামের কাজ। তবে সদস্যদের পরিবর্তন চলতেই থাকে। সামিন এবং ইবন ব্যান্ড ছেড়ে যায়, নাফি যোগ দেয় কি-বোর্ডে। বেসিস্ট দীপ্ত মিউজিক নিয়ে বিদেশে মাস্টার্স করতে চলে যায়, তার অনুপস্থিতিতে তানসীফ গেস্ট বেসিস্ট হিসেবে বাজাতে থাকে। এছাড়া গিটারিস্ট জিসান কিছুদিনের জন্য ব্যান্ডে যোগ দিলেও, পরবর্তী সময়ে সেও বিদেশে চলে যায়। 

এত ভাঙা-গড়ার পর হাইওয়ে ধীরে ধীরে তার স্থায়ী লাইনআপ খুঁজে পায়। বর্তমানে ব্যান্ডটির লাইনআপ দারুণ সব মিউজিশিয়ানে পূর্ণ। ড্রামসে স্যাম, যিনি শুরু থেকেই ব্যান্ডের সঙ্গে রয়েছেন। আর প্রিয় অন্যতম প্রধান গিটারিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দীপ্তর অনুপস্থিতিতে তানসীফ বেসিস্ট হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করছেন। আবার কি-বোর্ড নিয়ে নাফি ব্যান্ডের সাউন্ডে নতুন মাত্রা যোগ করে চলেছেন। ব্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে সাদ হাইওয়ে’র পথচলাকে সাবলীলভাবে গুছিয়ে রাখছেন অনবরত। এ ছাড়া, শোভন শুরু থেকেই সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং অতিরিক্ত সদস্য হিসেবে বাঁশিতে নাজম আনোয়ার ও জিম রয়েছেন ড্রামসে।

 

অ্যালবাম ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা:

শুরুতে গান প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নিয়াম মানা হতো না। নিজেদের অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে অ্যালবামের গান প্রকাশ করা হতো। তবে দ্বিতীয় অ্যালবাম থেকে অর্ডার অনুযায়ী গান দেওয়া হচ্ছে বলে ইথার জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, নির্দিষ্ট অর্ডারে না এলেও; ব্যান্ডের অ্যালবামের ক্রমে প্রথমে এসেছে ‘ট্রেন পোকা’, যা এখনো অসমাপ্ত। এই অ্যালবামে মুক্তি পাওয়া গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অবস্থান‘, ‘ঘোড়গাড়ি’ ও ‘আরেকটা ক্ষেত গান’। এগুলোর সঙ্গে আরও ৬টি গান যোগ করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান ইথার। এরপর এসেছে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘মৃতদেহের গান’, যা সম্পূর্ণ একটি অ্যালবাম হিসেবে অনলাইনে পাওয়া যায়। তৃতীয় অ্যালবাম ‘যাচ্ছি কোথায়’, যা আবার অসম্পূর্ণ; এতে মুক্তি পাওয়া গান হিসেবে ‘কিছু চিৎকার আছে’ ও ‘আধারি’ অন্তর্ভুক্ত, এবং বাকি ১০টি গান এ বছর একে একে মুক্তি পাবে। এ ছাড়া ‘Ayahuasca’ অ্যালবামের আওতায় ‘ছায়া’ নামক গান মুক্তি পেয়েছে, এবং বাকি গানগুলোর সংখ্যা এখনো নির্ধারিত হয়নি, সম্ভবত ৬-৭টি গান থাকবে; যা ‘যাচ্ছি কোথায়’ শেষ হওয়ার পর প্রকাশের সূচনা হবে।

যেভাবে তৈরি হয় গান:

হাইওয়ে’র গান তৈরির পদ্ধতি বরাবরই ভিন্নরকম। ব্যান্ডের প্রত্যেকটি গান ইথার নিজে লেখেন ও সুর করেন, বাইরের কারো লেখা বা সুর করা গান তারা করে না। শুরু থেকেই ইথারের হোম স্টুডিওতে কম্পোজ করা হতো, এখনো তাই হয়। ব্যান্ড মেম্বাররা আড্ডায় এসে নিজেদের পার্ট বাজিয়ে রেখে যায়, এরপর ইথার তা নিয়ে কাজ করে। তবে এখন মাঝে মাঝে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রফেশনাল স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়। যেমন, লাইভ ড্রামস টেক নেওয়ার দরকার হলে কিংবা ফাইনাল মিক্সিং-মাস্টারিং ইত্যাদির জন্য।

সবশেষে বলতে পারি, হাইওয়ে ব্যান্ডের পথচলা কখনোই সরলরেখায় এগোয়নি। বন্ধুত্ব, উত্থান-পতন, সদস্যদের পরিবর্তন, ব্যক্তিগত লড়াই; সব মিলিয়ে এ ব্যান্ডের যাত্রা অনেকটা একটা রোড ট্রিপের মতো, যেখানে নতুন নতুন মোড় আসে, কখনো ধুলোমাখা পথ, কখনো রঙিন আলো। তবে হাইওয়ের যাত্রা কখনো থামেনি। এ যাত্রা কত দীর্ঘ হবে, সেটা অনিশ্চিত।