আমি গ্রামের মানুষ, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পাড়েই কেটেছে আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়। তবে সে অধ্যায় শেষ করে যখন পারি দেই যান্ত্রিক শহরে তখন থেকেই একটা শ্বাসজনিত সমস্যা অনুভব করি। ঢাকার মানুষ মূলত শ্বাসকষ্টের রোগী। মাঝেমধ্যেই ইট-পাথরের চাপে তাদের দম আটকে যায়।
অল্পদিনের মাঝে আমিও মিশে গেলাম তাদের দলে। নিয়ম করে প্রতিদিন শ্বাস নিতে যেতে হয় ধানমন্ডি লেকে। লেকের পরিবেশ সন্তোষজনক না হলেও লেকের পাড় ধরে বড় কোনো গাছের নিচে ঝিম মেরে ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকলে এটলিস্ট ফার্মেসি থেকে শ্বাস নেওয়ার খরচটা বেচে যায়। কিন্তু আজ মনে হয় তাও সম্ভব নয়।
সন্ধ্যা থেকেই বসে আছি। আজ লেকের বাতাসে উদ্ভট উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কিছুতেই মনে প্রশান্তি আসছে না। সম্ভবত অস্থিরতার সর্বশেষ ধাপে অবস্থান করছি, এমন সময় ভাইয়ার ফোন।
অপ্রত্যাশিত এক খুশির সংবাদ মনকে মুহূর্তেই শীতল করে তুলল। আমি চট করে ওঠে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কাল দুপুরে গাড়ি, দূরের গন্তব্যে অনেকরকম প্রস্তুতি ব্যাপার-সেপার থাকে, আমার হাতে সময় আছে রাতটুকু; এরমধ্যে প্রস্তুতি পর্ব সেরে ফেলতে হবে। তাই বিদ্যুৎ গতিতে বাসায় ফিরেই ব্যাগ ঘুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে অফিস এবং দুপুরে গাড়ি আসবে অফিসের নিচে। সেভাবেই কাজ শেষ করে ভাইয়াকে কল দিলাম।
কিন্তু গাড়ি এলো না! সময় ব্যবস্থাপনা বাঙালিদের বেশ পুরোনো সমস্যা। যাই হোক, সেই গাড়ি এসেছে সন্ধ্যালগ্নে। হাতিরঝিল থেকে আমাদের রিসিভ করল। সঙ্গে ভাইয়ার দলবল এবং কিছু ছোট ভাইকে নিয়ে রওনা হলাম সমুদ্রের পথে। যেতে যেতে মাথায় ঘুরছিল নানারকম চিন্তাভাবনা।
স্বপ্নে দেখা সমুদ্রকে বার বার মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অতি উচ্ছ্বাসে ঢেউগুলোকে সামনে আনতে পারছি না। রাত গভীর হচ্ছে, তখন আমরা চট্টগ্রামের কাছাকাছি। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ড্রাইভার সাহেবের পরিচিত রাস্তা, মাসে দুচারবার যেতেই হয়। গর্ব করে বলতে বলতে গাড়ি ব্রেক করলেন।
অন্ধাকারে চেনা পথও অচেনা হয়ে যায়; গাড়ি ঘুরিয়ে আবার যেতে শুরু করলাম কক্সবাজারের পথে। যেতে যেতে এক নির্জন অরণ্যে ঢুকে গেলাম। আশপাশে কোনো গাড়ি নেই! ভাইয়া জানাল, এই এলাকার নাম চুনতি, এই রাস্তার এপার থেকে ওপার মাঝেমধ্যেই হাতি পারাপার হয়।
তবে এখন তাদের পারাপারের জন্য দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একশ কিলোমিটার রেললাইনের চুনতি, ফাঁসিয়াখালি ও মেধাকচ্ছপিয়ায় তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নির্মিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের চুনতিতে এলিফ্যান্ট ওভারপাস। বিষয়টা ইন্টারস্টিং! তবে আমি আশায় আছি একটি হাতি সামনে পড়বে। মনভরতি আনন্দ নিয়ে উপভোগ করব সেই দৃশ্য। এমন সময় গাড়ি কেঁপে উঠল, সামনে তাকাতেই দেখলাম রাস্তায় কয়েকটা কুকুর। আশার চোখে জল ঢেলে আবার সামনে আগাতে লাগলাম।
চোখ লেগে গেছে, সূর্যের মৃদু আলো চোখে পড়ে ঘুম ভাঙল সকাল পাঁচটায়। তখন আমরা কক্সবাজার। ব্যাগট্যাগ নামিয়েই পড়লাম হোটেল বিপাকে। সে গল্প আরেকদিন করব। আজ এগিয়ে যাই কলাতলী বিচের দিকে। আমার থেকে মাত্র একশ গজ দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শাণিত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নে দেখা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত।
সৌন্দর্য উপভোগ করতে তারাহুরো করতে নেই! আমরা পুলিশবক্সের নিচে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। এরপর আস্তে ধীরে গেলাম সমুদ্রের পাড়ে। গিয়ে যতটা না আনন্দ পেলাম তারচেয়ে বেশি ব্যথিত হলাম।
প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা খুবই বাজে। কলাতলী, সুগন্ধা, লাবনীতে সমুদ্র উপভোগ করতে মানুষের অতিরিক্ত আয়োজন যেন সমুদ্রকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিচ্ছে। তাই এই ভ্রমণের নাম ঠিক করলাম, ‘মানুষ দেখতে কক্সবাজার’।
প্রথমদিনের বাজে অভিজ্ঞতা পার করে দ্বিতীয় দিনের সূর্য উঠল। আজকের সূর্যকে বেশ মোলায়েম লাগছে। আমরা মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে চলে গেলাম হিমছড়ি থেকে আরও অনেক দূরে। কোথাও কেউ নেই, প্রাকৃতিক নির্জনতা আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।
আমরা সে বিচের নাম জানি না, তবে নাম দিয়েছি সাম্পান বিচ। সেখানকার নির্জন বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা, মেঘ কালো সারি সারি ঝাউবন, সৈকতের বুকে আছড়ে পড়া ছোট বড় ঢেউ আমাকে নিয়ে গেল অন্য পৃথিবীতে।
ভালো পজিশন দেখে হ্যামক টানিয়ে সারা দুপুর সমুদ্র বিলাস করার পর বিকেলটা ছিল আরেকটু অন্যরকম। ভাড়া করা স্কুটিতে আমার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের পাড় ধরে ছুটতে লাগলাম স্বর্গীয় গন্তব্যে।
আহা! সেই প্রশান্তি এখনো মগজে লেগে আছে। সেই দিন ভোলার নয়, নিশ্চয়ই সন্ধ্যার আকাশে কাঁসার থালার মতো বেরিয়ে আসা সূর্যের রূপকে ঘিরে সমস্ত সৌন্দর্যের আয়োজন আমাকে আবার নিমন্ত্রণ করবে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায়…
আপনার মতামত লিখুন :