প্রাণহীন উপত্যকায় চলাফেরা করা ভুতুড়ে পাথর!

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৫, ০৭:১৭ পিএম

প্রাণহীন উপত্যকায় চলাফেরা করা ভুতুড়ে পাথর!

ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত ডেথ ভ্যালি হলো পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চল। বাটির মতো দেখতে এই উপত্যকাটি প্রায় প্রাণহীন। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বাঁচার জন্য ন্যূনতম কিছুই দেয় না এই উপত্যকা। তাই ২২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ থেকে ২৪ কিলোমিটার প্রস্থের এই উপত্যকাটি কুখ্যাত ডেথ ভ্যালি নামে।

এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা আছে ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯১৩ সালের গ্রীষ্মে এটা রেকর্ড করা হয়েছিল। গড় তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক বৃষ্টিপাত মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার। ডেথ ভ্যালির গরমের কাছে হার মেনেছে আফ্রিকার সাহারা, কালাহারি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলগুলো। গোটা উপত্যকায় আছে গুটিকয়েক জলাশয় তবে সেগুলোর পানি খুবই লবণাক্ত। বালি, কাঁকর, পাথর আর পাহাড় ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই এই উপত্যকায়।

ডেথ ভ্যালি পার্কের পাহাড়চূড়ায় ‘রেসট্র্যাক প্লায়া’ নামে একটি শুষ্ক হ্রদ রয়েছে। এই শুষ্ক হ্রদে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির এমন কিছু রহস্যময় পাথর আছে, যেগুলো কারও সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় বলে দাবি করা হয় কয়েক দশক ধরে।

ডেথ ভ্যালি পার্ক

১৯৪৮ সালে ডেথ ভ্যালিতে অভিযান চালান একদল অভিযাত্রী। তাঁরা ডেথ ভ্যালির ভেতরে একটি রহস্যময় জলশূন্য হ্রদ খুঁজে পান। যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। হ্রদটির কাছে যেতে গেলে দুর্গম পথে গাড়িতে তিন ঘণ্টার সফর পার করতে হয় অভিযাত্রীদের। হ্রদটির নাম দেওয়া হয় রেসট্র্যাক প্লায়া। এই জলশূন্য হ্রদের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পাথর। বিস্ময়করভাবে তারা নিজে থেকে স্থান পরিবর্তন করতে পারে। এই ভুতুড়ে পাথরদের তৈরি করা ট্র্যাক থেকেই হ্রদটির নাম হয় রেসট্র্যাক প্লায়া। কখনও সরলরেখায়, কখনও বক্রপথে স্থান পরিবর্তন করে পাথরগুলি।মাঝেমাঝে দু’টি পাথর সমান্তরাল পথে কিছুদূর যাওয়ার পর দিক পরিবর্তন করে এবং ঠিক বিপরীত দিকে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। প্রমাণ হিসেবে পাথরগুলি শুষ্ক হ্রদের বুকে ফুটিয়ে তোলে গাড়ির চাকার দাগের মতো ছাপ। বোঝা যায় এই পথেই পাথরগুলি আগের অবস্থান থেকে নতুন অবস্থানে এসেছে। দেখা গেছে এককেজি থেকে সাড়ে তিনশো কেজির পাথরও স্থান পরিবর্তন করেছে এবং তা বোঝা গেছে তাদের ট্র্যাক দেখে।

রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথর

সাধারণ মানুষরাও এই রহস্যজনক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে কেউ কেউ বলেন, বছরের কোনও এক সময়ে বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় রেসট্র্যাক প্লায়াতে। চুম্বক পাথরগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের আকর্ষণেই নাকি স্থান পরিবর্তন করে। কেউ বলেন রেসট্র্যাক প্লায়ার নির্জন প্রান্তরে রাতের আকাশ থেকে নেমে আসে ভিনগ্রহের মহাকাশযান। এলিয়েনরা পাথরগুলি ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পালায়। কেউবা বলেন রাতের অন্ধকারে অপদেবতারা পাহাড় থেকে গড়িয়ে দেন পাথরগুলো। কেউ বলেন এখানে জলের অভাবে মারা যাওয়া কিছু স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের অতৃপ্ত আত্মা পাথর সরিয়ে জল খোঁজার চেষ্টা করে।

ভূবিজ্ঞানীদের মতে, রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথর নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি আসে ১৯৫৫ সালে। রেসট্র্যাক প্লায়াতে বেশ কয়েক মাস সময় কাটান বিজ্ঞানী এম. স্ট্যানলি। তিনি বলেছিলেন, বছরের কোনও কোনও সময় ডেথ ভ্যালির পাহাড়গুলি থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে রেসট্র্যাক প্লায়াতে নেমে আসে। তখন রেসট্র্যাক প্লায়া টলটলে এক হ্রদের আকার নেয়। যদিও জলের উচ্চতা মাত্র ৭-৮ সেন্টিমিটার। রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। তখন জল বরফে রূপান্তরিত হয়ে প্রসারিত হয়। বরফ ও বাতাসের যুগপৎ ঠেলায় পাথরগুলি স্থানচ্যুত হয়। স্ট্যানলির মতবাদ আইস-সিট মতবাদ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।

রহস্য উদঘাটনে নেমেছিলেন কিছু বিজ্ঞানী

কিন্তু ১৯৭৬ সালে দুই ভূবিজ্ঞানী ডুইট ক্যারে এবং রবার্ট শার্প রেসট্র্যাক প্লায়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁরা স্ট্যানলি’র আইস-সিট মতবাদের বিরোধিতা করেন। ক্যারে এবং শার্প, ভুতুড়ে পাথরগুলির চলার পথের বৈশিষ্ট্য এবং পাথরগুলির অবস্থানের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ করেন। এই দুই বিজ্ঞানী বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক ঝোড়ো বাতাসের কারণে পাথরগুলো সরে যায়। এই ঘটনা প্রতি বছর হতে পারে আবার দুই তিন বছর পর পরও ঘটতে পারে।

গ্রহবিজ্ঞানী র‌্যাল্‌ফ লরেন্স ২০০৭ সালে ‘রেসট্র্যাক প্লায়া’ নিয়ে গবেষণায় নামেন। ২০১১ সালে একই জায়গায় গবেষণা করতে যান সমুদ্রবিজ্ঞানী রিচার্ড নরিস এবং তাঁর ইঞ্জিনিয়ার ভাই জেমস নরিস। গ্রহবিজ্ঞানী র‌্যাল্‌ফ লরেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। লরেন্স-এর সাহায্য নিয়ে পাথরগুলির নড়াচড়া ক্যামেরাবন্দী করার জন্য রেসট্র্যাক প্লায়াতে স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা বসানো হয়। একই সঙ্গে রেসট্র্যাক প্লায়ার তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, প্রভৃতি আবহাওয়াগত পরিবর্তন নথিভুক্ত করার জন্য একটি ছোট আবহাওয়া কেন্দ্র বসিয়ে ফেলেন এই তিনজন। রহস্যময় পাথরগুলোর নড়াচড়া ট্র্যাক করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন আকারের কিছু পাথরের গায়ে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়ে আসেন। ফলাফল এসেছিল দুবছর পর।

বরফ জমেছে রেসট্র্যাক প্লায়াতে

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রিচার্ড আর জেমস রেসট্র্যাক প্লায়াতে  গিয়ে তাঁরা অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পান। মরুভূমির মতো শুষ্ক হ্রদটির তিনভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে বরফের পাতলা চাদর। বরফের স্তর দেখেই স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদ চাক্ষুষ দেখার কথা ভাবেন দুই ভাই। প্রচন্ড ঠাণ্ডার মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে ফেলেন। মৃত্যু উপত্যকায় কাটতে থাকে দিনের পর দিন। এক প্রাণান্তকর প্রতীক্ষায়।

অবশেষে এসেছিল বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩। সকাল ন’টা নাগাদ রোদ উঠলে বরফের পাতলা আস্তরণ ভাঙতে শুরু করেছিল। উপত্যকায় ঝাঁপিয়ে পড়া সকালের ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কায় ভেঙে যাওয়া বরফের প্লেটগুলি নড়াচড়া করতে শুরু করেছিল।বরফের প্লেটগুলি শক্ত জমিতে হড়কে হড়কে চলাচল করার সময় তাদের সামনে থাকা পাথরগুলোকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে শুরু করেছিল।  রিচার্ড এবং জেমস শক্তিশালী বাইনোকুলারে দিয়ে দেখেছিলেন, বিভিন্ন মাপের পাথরগুলো বরফের প্লেটের ধাক্কায় পাথরগুলো ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়া পাথরগুলির গতিপথ বদলে দিচ্ছে।

গতিপথ পাল্টে যাছে পাথরগুলোর

পাথরগুলো এত স্লথগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল খালি চোখে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না। ২০ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে রেসট্র্যাক প্লায়ার সব বরফ গলে গেল। দেখা গেল ৬০ টি পাথরের পিছনে নতুন করে  এগিয়ে যাওয়ার দাগ তৈরি হয়েছে। সমস্ত ঘটনার ছবি তুলে বিজ্ঞানী রিচার্ড এবং জেমস  শহরে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের গবেষণাপত্রে বলেছিলেন, “অনেক সময় বরফের প্লেটগুলি আয়তনে বিশাল হওয়ায় একসঙ্গে কয়েকশো পাথরকে একই দিকে ঠেলে বলে পাথরগুলো একই দিকে এগিয়ে যায়। ফলে গতিপথের ছাপ সমান্তরাল হয় এবং পাথরগুলো একই দূরত্ব অতিক্রম করে। রেসট্র্যাক প্লায়ার চলমান পাথরের রহস্য উদঘাটনে সফল তিনবিজ্ঞানী স্ট্যানলির আইস-সিট মতবাদটিকেই প্রমাণ করলেন ২০১৪ সালে, যা বিজ্ঞানী এম স্ট্যানলি ১৯৫৫ সালেই  বলে গিয়েছিলেন।

 

আরবি/শিতি

Link copied!