ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫

আজ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী দিবস

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৫, ১০:৪২ এএম
ছবি: সংগৃহীত

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় মহিলা সরকারপ্রধান। তার স্বামী জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তিনি ফার্স্ট লেডির ভূমিকা পালন করেন।

 ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের পর তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৯৬ সালে একটি স্বল্পস্থায়ী সরকারেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। যদিও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯৬ সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও ২০০১ সালে আবারও বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসে। খালেদা জিয়া ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনগুলোর প্রত্যেকটিতে নিজ দলের ৫টি সংসদীয় আসনেই জয়ী হন। 

ফোর্বস সাময়িকী ২০০৪ সালে তাকে বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারী নেত্রীর তালিকায় ১৪তম, ২০০৫ সালে ২৯তম এবং ২০০৬ সালে ৩৩তম অবস্থানে স্থান দেয়।

বেগম খালেদা জিয়ার পরিচয়

বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম নাম ছিল খালেদা খানম পুতুল। তিনি ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারে তিন বোন ও দুই ভাই ছিলেন। তার পিতামহ হাজী সালামত আলী এবং মাতামহ তোয়াবুর রহমান। তার পিতা ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী আর মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। তার পৈতৃক নিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে মজুমদার বাড়ী।

বেগম খালেদা জিয়ার স্বামী ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। যিনি বীরউত্তম খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে, যখন জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন এবং ডি এফ আই এর কর্মকর্তা হিসেবে দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। তাদের বড় ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন অবস্থায় থাকেন তবে ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি তার বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত অবস্থান করেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জামশেদের অধীনে বন্দী ছিলেন এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে বেগম জিয়া ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূই। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও বেগম জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না।

প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবন
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের আহ্বানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং বেগম জিয়া এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। একই বছর ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তার প্রথম বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হলে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বে বিএনপি পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন
১৯৮৩ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তিনি বিএনপির মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে, কিন্তু ২১ মার্চ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল এবং ৫ দল হয়ে যায়, এবং ৮ দল নির্বাচন করতে যায়। এর পর, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এবং পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে "এরশাদ হটাও" আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি এরশাদ সরকারের পতনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয়লাভ করেন।

প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদকাল
১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে একটি বিল উত্থাপন করেন। একই দিনে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে স্বপদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাশ হয়।

প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদকাল
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে একদলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়। বিরোধীদলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ও তার দল ওই একক নির্বাচনে অংশ নেন। আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে। তবে, এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল গণ আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপের পর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।

প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদকাল
২০০৫ সালে খালেদা জিয়া জাপানের প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি সঙ্গে টোকিওতে সাক্ষাৎ করেন। এর পর, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টি নিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে এবং ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।

পদক ও সম্মাননা
২০১১ সালের ২৪ মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া "ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি" পদক গ্রহণ করেন। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোন বিদেশী নেত্রীকে দেওয়া প্রথম সম্মাননা। এরপর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) তাকে "মাদার অব ডেমোক্রেসি" সম্মাননা প্রদান করে।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে খ্যাত। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনটি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অমোচনীয় চিহ্ন রেখে যাবে।