বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা যার নেশা

দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৫, ০৫:০১ পিএম

লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা যার নেশা

লোকসংস্কৃতি গবেষক মীর সাখাওয়াত হোসেন

পেশায় তিনি আইনজীবী যার বিচরণ মূলত ন্যায়-অন্যায় বা অপরাধবিষয়ক কর্মকাণ্ডে। আইনের ধারা উপধারা ও অনুচ্ছেদ নিয়েই যার দিনরাত ব্যস্ত থাকার কথা, সেই মানুষ যদি পেশার বাইরে বিশেষ কোনো কাজ বা কোনো বিশেষ মহৎ ব্যক্তি ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণায় লিপ্ত থাকেন, লেখেন নাটক ও অন্যান্য সাহিত্য, লেখালেখি করে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন তাহলে কেমন হয়?

তেমনই এক কাজপাগল গবেষক ও সংগ্রাহকের সন্ধান পাওয়া গেছে দক্ষিণ-পশ্চিামাঞ্চলের জেলা শহর ঝিনাইদহে। ৭৪ বছর বয়স্ক মীর সাখাওয়াত হোসেন ১৯৫২ সনের ১ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মরমী কবি পাগলাকানাইয়ের মাজারসংলগ্ন ফকিরাবাদ গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মীর সাখাওয়াত হোসেন এখন বাস করেন ঝিনাইদহ শহরের পাগলাকানাই সড়কে নিজ বাড়িতে। পেশায় পুুরাদস্তুর ও কঠোর আইন পেশায় নিয়োজিত মানুষটির নেশা লোকসাহিত্য, সংগ্রহ, লোকায়িত সংস্কৃতি গবেষণা। পাগলাকানাই স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদের সহসভাপতির দায়িত্ব পালনকারী মীর সাখাওয়াত হোসেন ‘দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ’-এর ঝিনাইদহ প্রতিবেদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন তার গবেষক হয়ে ওঠার কথা।

তার লেখা ‘ঝিনাইদহ লোকসংস্কৃতি’ প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে। এর আগে তার লেখা নাটক ‘পাগলাকানাই’ প্রকাশ পায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর একই বছরের আগস্টে প্রকাশিত হয় আর আরেক নাটক ‘মন পবনের নাও’। এ বছর ঢাকায় একুশে বইমেলায় মীর সাখাওয়াত হোসেনের বিশ্ব কাঁপানো করোনাভাইরাস নিয়ে লেখা কবিতার বই ‘করোনা বিলাস’ প্রকাশিত হয়েছে। এটি তার লেখা বইয়ের চতুর্থ প্রকাশনা।

পেশাজীবী হিসেবে আইনপেশায় তার কর্মকাণ্ড বিষয়ে মীর সাখাওয়াত হোসেন জানালেন, এ পেশাতেও তিনি সম্পূর্ণ ‘প্রফেশনাল’। সাধারণত অপরাধীদের পক্ষে বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী বা ওই সময় কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ধর্ষক, ডাকাত, ছিনতাইকারী, সুদ কারবারি, চোরাচালানি এবং হত্যাকারীর মতো অপরাধীদের পক্ষে তিনি কখনো আদালতে লড়েন না, বিত্তহীন, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া মানুষ, প্রতিবন্ধী যার পয়সা নেই, তার জন্য নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে বিচারকার্যকে বিচারের মুখোমুখি করেন তিনি।

মীর সাখাওয়াত হোসেন জানালেন, তার নাটক ‘পাগলাকানাই’ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পেলেও তা লেখা হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যা সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭২ সালে। এরপর বেশ কয়েকবার নাটকটি বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী মঞ্চায়ন করলেও তা প্রকাশের মুখ দেখেনি। ঝিনাইদহ এলাকায় লোকসংস্কৃতির ধারক-বাহক মানুষটি গ্রাম্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এলাকার সব মানুষের কাছে সমাদৃত।

শুধু আইনের ধারা-উপধারা ও আদালতের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ জজকোর্টে আইন পশায় আসা ব্যক্তিটি ঘুরে বেড়ান গ্রাম-গ্রামান্তরে, সংগ্রহ করেন গ্রাম সংস্কৃতির তথ্য-উপাত্ত। লোকসংস্কৃতিকে জনসমক্ষে, বিশেষ করে এলাকার মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের সব মানুষের কাছে পরিচিত, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে ছুটে চলা মীর সাখাওয়াত হোসেন জানালেন, ছোটবেলা থেকেই লোক সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি নিজেকে কখন যে জড়িয়ে ফেলেছেন, তা বুঝতে পারেননি। একেবারেই সাদাসিধে, স্বল্পভাষী এবং প্রচারবিমুখ মানুষটি এ পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি ধুয়া, জারি, পাঁচালি সংগ্রহ করেছেন।

তিনি জানালেন, মরমী কবি পাগলাকানাই বিষয়ে তার পৌত্র ও প্রো-পৌত্র যে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন, তা তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, ঝিনাইদহের সাহিত্য ও লোক গবেষণাবিষয়ক অসামান্য কাগজ ‘বেগবতি’তে মীর সাখাওয়াত হোসেনের লেখা ‘ইদুবিশ্বাস’ গত বছর মার্চে প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তি জীবনে শেষ বয়সে দুই বছর আগে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে লোকসাহিত্যপাগল মীর সাখাওয়াত হোসেনের। একমাত্র মেয়ে এখন শ্বশুরালয়ে, তিনি পাগলাকানাই সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক আর ছেলেটি এখন বাবার পথ ধরে রীতিমতো আইন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।

আরবি/এসএম

Link copied!