মুসলিম উম্মাহর জন্য ঈদুল ফিতর একটি পবিত্র ও আনন্দময় উৎসব, যা দীর্ঘ এক মাসের সংযম, আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের পর উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঈদুল ফিতর শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জাতীয় সংহতি, ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঈদ বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ ও বিজয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। যুগে যুগে এই উৎসব জাতীয় ঐক্য, মানবতা ও সামাজিক সম্প্রীতির বার্তা বহন করেছে। তাই, ঈদুল ফিতর বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
বাংলায় ঈদুল ফিতরের সূচনা
বাংলার ইতিহাসে ঈদুল ফিতরের প্রচলন বহু শতাব্দী পুরোনো। মুঘল শাসনামলে এই উৎসব আরও বেশি গুরুত্ব পায়, বিশেষ করে সম্রাট আকবর ও আওরঙ্গজেবের শাসনামলে। তারা মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য বড় আয়োজন করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭) ঈদ মুসলমানদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে টিকে ছিল এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
ঈদুল ফিতর ও ভাষা আন্দোলন (১৯৪৭-১৯৫২)
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভাষা আন্দোলন, যা ঈদুল ফিতরের সময় বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ শুরু করে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়েও ঈদ ছিল একতা ও প্রতিবাদের প্রতীক। মসজিদের খুতবা ও ঈদের নামাজের ভাষণে ন্যায়বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলা হতো, যা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদুল ফিতর (১৯৭১)
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদুল ফিতর ছিল এক ভিন্ন বাস্তবতা। পাকিস্তানি বাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে বহু মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয় বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেদিন ঈদের নামাজ ছিল শোক ও প্রতিরোধের বার্তা বহনকারী।
সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে ঈদ পালন করলেও মুক্তিযোদ্ধারা ও সাধারণ মানুষ বিজয়ের জন্য দোয়া করেছিল। সারা দেশে ঈদের আনন্দ ছিল ম্লান, কিন্তু জাতির জন্য এটি ছিল দৃঢ় মনোবলের প্রতীক।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ (১৯৭২)
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদুল ফিতর ছিল আনন্দ ও বেদনার মিশ্র অনুভূতির এক উৎসব। দেশ স্বাধীন হলেও যুদ্ধের ক্ষতি, লাখো মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো জাতিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল।
সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেন। তিনি ঈদের নামাজে অংশ নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। সে বছর ঈদের খুতবায় শান্তি, পুনর্গঠন ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোকপাত করা হয়।
ঈদুল ফিতর: বাংলাদেশের উন্নতির প্রতিফলন
স্বাধীনতার পর থেকে ঈদুল ফিতর বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এখন ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসে এবং বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেমন—ঈদের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, ঘরমুখো মানুষের জন্য বিশেষ ট্রেন-বাস সার্ভিস এবং দরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম।
আজকের বাংলাদেশে ঈদ এক বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, বিপণিবিতানগুলোতে কেনাকাটার ভিড় লাগে, এবং লাখো মানুষ গ্রামে ফিরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে। ঈদ এখন কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও সংস্কৃতির প্রতীক।
বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি জাতির ইতিহাস ও সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ- সব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঈদ জাতীয় সংহতির প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। সময় বদলালেও ঈদ এখনও ঐক্য, আশা ও ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসে, যা বাংলাদেশকে সব সংকট কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
আপনার মতামত লিখুন :