উ লিৎজিয়ান (৬২৪-৭০৫ খ্রিষ্টাব্দ) চীনের ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ও বিতর্কিত চরিত্র। তিনি একমাত্র নারী সম্রাজ্ঞী হিসেবে শাসন করেছেন এবং তার উত্থান এবং তাং রাজবংশের অধীনে শাসন চীনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একজন কনকুবাইন থেকে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত এবং প্রভাবশালী সভ্যতার সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে তার যাত্রা ছিল প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকা ভাঙার একটি গল্প।
শৈশব এবং ক্ষমতায় উত্থান
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী উ লিৎজিয়ান একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবার, উ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা উ শিহু ছিলেন একজন উন্নত কর্মকর্তা, তবে তার পরিবারের মর্যাদা প্রথমে তাকে রাজনৈতিক দুনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার সুযোগ দেয়নি। তরুণ বয়সে, উ লিৎজিয়ান সম্রাট তাইজংয়ের কাছে সম্রাটের কনকুবাইন হিসেবে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন।
প্রথম দিকে তার জীবন বেশ সাধারণ ছিল, তবে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং রাজকীয় কূটনীতির প্রতি তার দক্ষতা শীঘ্রই আশপাশের মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

তাইজংয়ের মৃত্যুর পর ৬৪৯ সালে, উ লিৎজিয়ানকে একটি বৌদ্ধ মঠে পাঠানো হয়, যা ঐতিহ্য অনুসারে একটি কনকুবাইনকে করা হতো যদি সে সম্রাটের প্রতি অনুকূলতা হারায়। তবে এটি তার কৌশলগত অগ্রযাত্রার শুরু ছিল।
উ লিৎজিয়ান তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য পরবর্তী সময়ে মঠ থেকে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন এবং ৬৫৫ সালে সম্রাট গাওজং তাকে আবার রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনে।
সিংহাসনে আরোহণের পথ
উ লিৎজিয়ান তার ক্ষমতার উত্থানে ধীর এবং কৌশলী রাজনীতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি দ্রুত রাজপ্রাসাদে প্রভাব অর্জন করেন, প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার সমর্থকদের শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তিনি ৬৫৫ সালে সম্রাট গাওজংয়ের স্ত্রীর মর্যাদা পান, কিন্তু তার অশ্বেত শাসন কেবল এখানেই থামেনি। উ লিৎজিয়ান ছিলেন এক ধরনের অভিজ্ঞানী এবং নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল, রাজপরিবারের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীয়করণ করতে সক্ষম হন।
৭০৫ সালে সম্রাট গাওজংয়ের মস্তিষ্কে স্ট্রোক হওয়ার পর, উ লিৎজিয়ান আসল ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে কার্যকরীভাবে শাসন করতে থাকেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রুদের নির্মূল করেন এবং রাজপরিবারের অভ্যন্তরে নিজেকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছান।
সম্রাজ্ঞী থেকে সম্রাটে
৭০৯ খ্রিষ্টাব্দে উ লিৎজিয়ান ইতিহাস সৃষ্টি করেন যখন তিনি নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং একটি নতুন শাসনকালের সূচনা করেন, যেটি ছিল ঝৌ রাজবংশ (৬৯০-৭০৫ খ্রিষ্টাব্দ) নামে পরিচিত। তিনি চীনের ইতিহাসে একমাত্র নারী হিসেবে সম্রাট হওয়ার দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেন, যা ঐতিহ্যগত পুরুষ শাসকদের বিরুদ্ধে একটি সাহসী চ্যালেঞ্জ ছিল।
তিনি সম্রাজ্ঞী নয়, সম্রাট শিরোনাম গ্রহণ করেন, যা তার লিঙ্গ সংকেতের বাধা ভেঙে পুরুষ সম্রাটদের সমকক্ষ হওয়ার লক্ষণ ছিল।
তার শাসনকালে উ লিৎজিয়ান একটি সিরিজ সংস্কার গ্রহণ করেন, যা তার ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে এবং রাজ্যের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করেছিল। তিনি যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতেন, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে। উ লিৎজিয়ান ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল সমর্থক, যা তিনি শাসন বৈধতা প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করতেন।
তিনি তাং সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং পূর্ব এশিয়ায় তার কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, যা তার শাসনকালের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিল।

উত্তরাধিকার
উ লিৎজিয়ানের শাসন বিতর্কের বাইরে ছিল না। তাকে অনেকেই নির্মম হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন, বিশেষত যখন তার ক্ষমতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঐ সময়কার বেশকিছু বিবরণ মতে, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যার জন্য সমালোচিত হয়েছেন, তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরও বাদ দেন এবং গোপন পুলিশ ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করেছিলেন।
তবে যত যাই বলেন না কেন, তার শাসনকাল ছিল উল্লেখযোগ্য সংস্কারের, সংস্কৃতির, এবং কলার প্রসারের।
তবে উ লিৎজিয়ানের মাত্র ১৫ বছরের শাসনকাল, চীনের ইতিহাসে এক অবিচ্ছিন্ন অবদান রেখেছিল। তার শাসনকাল চীনা সমাজে নারীদের ভূমিকা পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
চীনের ইতিহাসে একমাত্র সম্রাজ্ঞী হিসেবে তার অস্তিত্ব ঐতিহ্যগত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং নেতৃত্ব ও ক্ষমতায় নারীদের ভূমিকা নিয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনার সূচনা করেছিল। তার শাসনকাল নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় ভূমিকা রাখার পথ তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল।
উ লিৎজিয়ানের জীবন এবং শাসন চীনের প্রাচীন ইতিহাসে ক্ষমতা, লিঙ্গ, এবং রাজনীতি নিয়ে জটিলতার প্রতিফলন। একটি রাজপাল কনকুবাইন থেকে চীনের একমাত্র নারী সম্রাটে তার উত্থান প্রমাণ করে যে তিনি কেবল ক্ষমতার খেলায় নয়, বরং ঐতিহ্যগত লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে দৃষ্টি রেখেছিলেন। তার শাসন চীনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে, যা সম্রাট হিসেবে নারীদের ক্ষমতায় অধিকার নিয়ে আজও আলোচনার প্রেরণা দেয়।
আপনার মতামত লিখুন :