রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

কাওরান নাকি কারওয়ান বাজার?

জুবায়ের দুখু

প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২৫, ০৭:২১ পিএম

কাওরান নাকি কারওয়ান বাজার?

ছবি: ব্যস্ততম রাজধানীর কারওয়ান বা কাওরান বাজার

রাজধানী ঢাকার বয়স অনুযায়ী এ শহরের প্রাচীনতম বিপণিকেন্দ্র কারওয়ান বাজার। আর এই বাজার সারা ঢাকাবাসীর জন্য খাদ্যসম্ভার নিয়ে বসে থাকে। গরীব থেকে ধনী, কামার-কুমার, জেলে, হিন্দু-মুসলিম সবাই একযোগে এই বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি সদাই নিয়ে বাড়ি ফেরে।

শহরের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় পাইকারি ও খুচরা বাজার এটাই। ঢাকার তেজগাঁও থানার কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর পাশে প্রায় ৫০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই বাজারের চারটি বিশেষায়িত মার্কেট ও অন্যান্য স্থাপনা মিলিয়ে এখানে দোকানের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি।

ইতিহাস বলছে ঢাকার বয়স চারশ বছর আর নগর ঢাকার বয়স তার-ও বেশি। সে প্রেক্ষাপটে কারওয়ান বাজারের বয়সও ইতিহাস অনুযায়ী। এ দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে নগরের পরিচিত স্থান কারওয়ান বাজার। তবে কারওয়ান নাকি কাওরান, কোনটা সঠিক? এ নিয়ে রয়েছে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক।

কারওয়ান বাজার দেশের প্রধানতম খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই বাজারটি বেশ কয়েকশ বছরের পুরোনো। এখানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই রয়েছে দারুণ সমাহার।

কারওরান বাজারের পত্তন সেই মোগল আমলে। মোগল আমলে ঢাকার বিস্তার ছিল মিরপুর পর্যন্ত। আসল ঢাকা ছিল নবাবপুর থেকে সদরঘাট। রমনায় অভিজাত দুটি পাড়া। আর তারপর ক্যানেল বা খাল। রাস্তা তো তেমন ছিল না।

ভারতবর্ষের সম্রাট ও শূরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা শেরশাহ শূর (১৫৩৮-১৫৪৫) সুলতানি বাঙলার রাজধানী সোনারগাঁ থেকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘সড়ক-ই-আযম’ বা ‘গ্র্যান্ড ট্রাক রোড’ নির্মাণ করেন।

দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান, পথচারীদের নিরাপত্তা, রাত্রিযাপন, সংবাদবাহকের কারণে এই সড়কে প্রথম ঘোড়ার ডাকের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই। পথে দুর্ঘটনা এড়াতে বা যাত্রী ও গাড়ি এসবকে নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন প্রয়োগে সেকালে শেরশাহ শূর এ সড়কে নিরপত্তাচৌকি ও সরাইখানা স্থাপন করেছিল।

এ বিষয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর লিখেছেন, এই চৌকির পাশে ছিল একটি কারওয়ান সরাই বা সরাইখানা। শহরে ঢোকার আগে পথিক এখানে জিরিয়ে নিতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন বা থাকতেন। আবার মাঝে মাঝে বণিকেরা কাঁরাভা (কারাভান) নিয়ে যখন আসতেন, তখন হয়তো নামতেন এই চৌকিতে। সেই কাঁরাভা থেকেও তো হতে পারে কারওয়ান বাজার।

ইতিহাস বলছে, দিল্লির সুলতান শেরশাহ বিখ্যাত গ্রান্ড ট্রাংক রোড বা সড়ক-ই-আজম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন৷ ঢাকা থেকে টংগী পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাংক রোডের অংশ পুনরায় নির্মিত হয় ঢাকার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে। সে সময় থেকেই এই রাস্তার দ্বারে দ্বারে স্থাপিত সরাইখানা। পরে পুনরায় সংস্কার করা হয় মীরজুমলার আমলে।

সরাইখানার আরেক নাম বলা হত কারাবান। বর্তমান কারওয়ান বাজার এলাকায় ছিল এমনি একটি সুপরিচিত কারাবান বা সরাইখানা। শত বছরের ব্যবধানে সেই কারাবান ভিন্নভাবে উচ্চারিত হতে হতে আজকের কারওয়ান বাজারে এসে ঠেকেছে। ইতিহাস পাল্টাতে পাল্টাতে হয়তো আজ সেই সরাইখানা নেই, কিন্তু কারওয়ান বাজার নামের মধ্যে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে মীরজুমলার নির্মিত সেই কারাবান বা সারাইখানার স্মৃতি।

কারওয়ান বাজার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে অন্য একটি তথ্য বলছে, ১৭’শ শতাব্দী থেকেই এখানে বাজার ছিল। ১৮’শ শতাব্দীর শেষের দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মারওয়াড়ী ব্যবসায়ী এখানে প্রথম মার্কেট খোলেন। তার নামেই এই বাজারের নামকরণ হয়েছে।

কারওয়ান বাজার না-কি কাওরান বাজার এ নিয়ে যেমন মতভেদ আছে, তেমনই ইতিহাসে এই বাজারকে কেন্দ্র করে আছে নানা গল্প, ১৮ শতকের পূর্বে এই স্থানটি বাঁশবাজার নামেও পরিচিত ছিল। সে সময় নড়াই নদী (বর্তমান হাতিরঝিল) ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযুক্ত, হোটেল সোনারগাঁওয়ের অংশে ছিল নদীর ঘাট। এই ঘাটে থামত বাঁশবোঝাই নৌকা। ঢাকার মানুষজন ঘর-দরজা বানাতে কিংবা মেরামত করতে ছুটে আসত বাঁশবাজারে।

ঢাকা তখন অনেকটা গ্রাম। নৌপথের সুবিধার কারণে একসময় এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল এনে এই বাঁশবাজারে পাইকারি বিক্রি শুরু করেন। তার ফলের কদর অল্প দিনের মধ্যেই বেড়ে যায়। ওই ব্যবসায়ীর নাম ছিল কাওরান সিং। ধীরে ধীরে মানুষ বাঁশবাজারকে ডাকতে শুরু করে কাওরান সিংয়ের বাজার। কালক্রমে কারওয়ান বাজার হিসেবে খ্যাতি পায়।

সেই ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে রাজধানীর পত্তন হলেও আমরা যদি লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাই নতুন ঢাকা গড়ে উঠেছে ১৯০৫ সাল থেকে রমনাকে কেন্দ্র করে। রমনার বৃক্ষরাজি আর নিবিড় পরিবেশ এই নগরের সৌন্দর্য আরও ফুটিয়ে তুলেছে।

১৯৪৬ সালে শহর ঢাকা ছিল কেমন সেই প্রসঙ্গে বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘১৯৪৬ সনে ঢাকা শহর কেমন ছিল? দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে নদীর মধ্যে ঢাকা শহর ঢিবির মতো জেগে আছে। এই ঢিবিটি উত্তরের দিকে ছড়ানো। আর ঢিবিটি কেটে বেরিয়ে আছে ফাঁটা তরমুজের মতো, জলার পর জলা। একটু হাঁটলেই জলা, একটু হাঁটলেই বনজঙ্গল, একটু হাঁটলেই গ্রাম, সে জন্য জলা জঙ্গল গ্রামের মধ্যেই ঢাকা শহরটা গম্বুজের মতো।’

ইতিহাস থেকে আজ কারওয়ান বাজার সমৃদ্ধ হয়ে রূপে ও গুণে। এই বাজারে এখান বিশ্বমানের খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা এই বাজারটি ঢাকাবাসীকে সেবা প্রদান করেই যাচ্ছে। টাটকা সবজির খোঁজে শহরে বিভিন্ন এলাকা থেকে এই বাজারেই ছুটে আসতে হয় লোকজনকে।

তবে আমরা যদি এখনো বাজারের ব্যাংক কিংবা দোকানের সাইনবোর্ডগুলোর দিকে লক্ষ্য করি তবে কোথাও কারওয়ান বাজার কোথাও কাওরান বাজার লেখা আছে। কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশন সাইনবোর্ডে লেখা আছে কারওয়ান বাজার, আবার বিভিন্ন ব্যাংকের সাইনবোর্ডে লেখা আছে কাওরান বাজার। অনলাইন করলে আমরা দুটি তথ্যই পাই। সম্ভব কারওয়ান বাজার না-কি কাওরান বাজার এই দ্বন্দ্বটি আজকের না, এই দ্বন্দ্বটি ইতিহাসবহল।

আরবি/জেডি

Link copied!