যে সময় নারী জন্মই যেন ছিল এক অভিশাপ, শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ, আর স্বপ্ন দেখা ছিল অপরাধ- তখন এক নারী নীরবে, সাহসের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন এক আলোর পথ। তিনি না ছিলেন কোনো রাজন্যবর্গের সন্তান, না তার হাতে ছিল কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা-কিন্তু ছিল একটি অদম্য বিশ্বাস: নারীও মানুষ, নারী অধিকারপ্রাপ্ত, নারীও শিক্ষার যোগ্য।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ছিলেন সময়ের বিপরীতে দাঁড়ানো এক অশ্রুতপূর্ব কণ্ঠস্বর, যিনি এক হাতে কলম আর অন্য হাতে সাহসের প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু করেছিলেন এক বিপ্লব। তিনি দেখিয়েছিলেন, ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা নারীও পারে জাতির শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠতে।
এই অনন্য সাহসী নারীই নারীর অধিকার, শিক্ষা ও সম্মানের জন্য ছিলেন এক অগ্রপথিক। তার জীবন ছিল সংগ্রামময়, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ভবিষ্যতের জন্য এক দীপ্ত আশা।
আজ থেকে শতাব্দীরও বেশি আগে, যখন সমাজে নারীরা পর্দার আড়ালে বন্দি, তখন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি এমন সমাজের, যেখানে মেয়েরা পড়তে পারবে, লিখতে পারবে এবং আত্মনির্ভর হতে পারবে। আজ তিনি শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নারী শিক্ষার পথিকৃৎ নন, বরং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রথম নারীবাদী কণ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত।
কে ছিলেন বেগম রোকেয়া?
১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম নেয়া রোকেয়া একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বড় হন, যেখানে মেয়েদের শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তাঁর বড় ভাই গোপনে তাঁকে বাংলা ও ইংরেজি শিখিয়ে দেন- যা রোকেয়ার জীবনের দিগন্ত পাল্টে দেয়।
যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও রোকেয়া হয়ে উঠেছিলেন এক প্রখর চিন্তাবিদ, লেখক ও সমাজ সংস্কারক। তার লেখনী ও ভাষণ নারীদের বন্দিত্ব ও পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে ছিল তীক্ষ্ণ ও সাহসী।
স্বপ্নকে বাস্তব করেছেন: সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল
১৯১১ সালে, যখন মুসলিম মেয়েরা লেখাপড়া করতই না বলা চলে, তখন রোকেয়া কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। প্রয়াত স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের রেখে যাওয়া অর্থ দিয়ে শুরু করা হয় মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে।
সামাজিক বিরোধিতা, হুমকি ও অপমান সত্ত্বেও রোকেয়া দমে যাননি। অনেকে বলেছিল তিনি মেয়েদের পশ্চিমা সংস্কৃতিতে কলুষিত করছেন। কিন্তু তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল- নারীশিক্ষা বিলাসিতা নয়, এটি অধিকার।
আজ এই স্কুলটি তাঁর অনন্য অবদানের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
কলম দিয়ে ভাঙলেন কুসংস্কারের দেয়াল
রোকেয়ার কলম ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯০৫) একটি কাল্পনিক ‘লেডিল্যান্ড’ দেখায়, যেখানে নারীরা শাসন করে এবং পুরুষেরা পর্দার অন্তরালে। এই ব্যঙ্গাত্মক কাহিনী ছিল নারীবাদী চিন্তার এক যুগান্তকারী প্রকাশ।
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘আবরোধবাসিনী’-তে তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেন নারীদের গৃহবন্দি রাখার প্রথা এবং ধর্মের অপব্যবহারকে।
তিনি লিখেছিলেন: ‘নারীদের যদি উপকার করতে না পারো, অন্তত ক্ষতি করো না; তাদের তাদের ভাগ্যেই ছেড়ে দাও।’
এক সীমাহীন উত্তরাধিকার
৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পূর্তির দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ‘রোকেয়া দিবস’ পালিত হয়।
আজ বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার নিয়ে চলমান সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে, রোকেয়ার দর্শন ও অবদান হয়ে উঠেছে আরও প্রাসঙ্গিক।
যে পথ ধরে আজ লক্ষ-কোটি নারী শিক্ষা, চাকরি ও নেতৃত্বের মঞ্চে উঠে আসছেন- সে পথ প্রস্তুত করেছিলেন রোকেয়া। যিনি মুখ খুলেছিলেন যখন নীরবতা ছিল বাধ্যতামূলক, যিনি গড়েছিলেন যখন সবাই ভাঙতে চেয়েছিল, এবং যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যখন নারীদের স্বপ্ন দেখতে নিষেধ ছিল।
আপনার মতামত লিখুন :