ঢাকা সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

জাহানারা ইমাম, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অমর নাম,  ‘শহীদ জননী ’ বা  ‘মাতৃজননী’ নামে খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধের চিত্র অঙ্কন এবং তার দেশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারের জন্য তাকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে। তার লেখনী, আন্দোলন এবং ত্যাগের মাধ্যমে তিনি শুধু এক নিঃস্বার্থ মা হিসেবে নয়, একজন দৃঢ় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন।

তার জীবন কষ্ট, সাহস এবং অপরিসীম দৃঢ়তার এক অনন্য চিত্র। জাহানারা ইমাম শুধু নিজের সন্তানের জন্য নয়, সব শহীদের মা হিসেবে বাংলার স্বাধীনতার জন্য নিজেদের প্রাণ দিয়ে লড়া সব মানুষের গল্পগুলো সংরক্ষণ করেছেন।

শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি 

জাহানারা ইমাম ১৯৪৬ সালের ৩ মে, অবিভক্ত বাংলার এক প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা, সৈয়দ আব্দুল আলী ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক এবং বুদ্ধিজীবী, এবং পরিবারের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ভাবনা ছিল বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ১৯৬০-এর দশক ও ১৯৭০-এর শুরুর দিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা প্রতিবাদ তাঁর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

তবে তার জীবনের প্রকৃত পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। সেই যুদ্ধ এবং তার পরিণতি জাহানারা ইমামের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ব্যক্তিগত ক্ষতি

১৯৭১ সালে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের সময় ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এই সময়ে, জাহানারা ইমাম নিজেকে এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে আবিষ্কার করেন। তার বড় ছেলে শফিক, যিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক উদ্দীপ্ত সমর্থক ছিলেন, যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হন।

শফিকের মৃত্যু ছিল জাহানারা ইমামের জীবনের একটি মর্মান্তিক মুহূর্ত, যা তাকে স্বাধীনতার সংগ্রামে আরও শক্তিশালী এবং সংকল্পবদ্ধ করে তোলে।

ছেলেকে হারানোর যন্ত্রণার মধ্যেও জাহানারা ইমাম নিজের শোককে এক রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করেন। তিনি যুদ্ধের শহীদের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে তাদের ভূমিকা সবার সামনে তুলে ধরেন।

 ‘শহীদ জননী ’

জাহানারা ইমাম শহীদ জননী বা মাতৃজননী নামে পরিচিত হন, কারণ তিনি শুধু নিজের সন্তানকে হারাননি, বরং পুরো জাতির শহীদ সন্তানদের জন্য এক প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এই উপাধি শুধু তার ব্যক্তিগত ক্ষতির পরিচায়ক নয়, বরং তার সমগ্র জাতির জন্য গৌরবেরও প্রতীক।

তার এই অবদান শুধু তার সন্তান শফিকের জন্য ছিল না, বরং তিনি একত্রভাবে সব শহীদ পরিবারের দুঃখ-কষ্টের প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে বারবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষার জন্য একাধারে ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস।

সেই বইটি

জাহানারা ইমামের সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক অবদান ছিল ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার বই-  ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এই বইটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অভিজ্ঞতার একটি খণ্ডচিত্র। বইটিতে তিনি নিজের অনুভূতি, স্বজন হারানো কষ্ট এবং দেশের জনগণের সংগ্রামের কথা লিখেছেন। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা ছিল না, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটি মূল্যবান দলিল হয়ে উঠেছিল।

এই বইটি একদিকে যেমন ব্যক্তিগত শোকের দলিল, তেমনি এটি বাংলার মানুষের সংগ্রাম এবং মুক্তির পথে তাদের অসীম ত্যাগের এক ইতিহাসও। এটি পরবর্তীতে বহু ভাষায় অনূদিত হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য সংরক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়।

রাজনৈতিক কর্মী ও আইনি সংগ্রাম

জাহানারা ইমামের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগ্রাম শুধু তার লেখনী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দাবিতে তিনি একাধারে প্রতিবাদী ছিলেন। এই সংগ্রাম তাকে শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দৃঢ় নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

১৯৯৯ সালে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন।

সাহস এবং প্রতিরোধের এক অমর দৃষ্টান্ত

জাহানারা ইমামের জীবন ছিল এক সাহসিকতার, ত্যাগের এবং সত্যের প্রতি অঙ্গীকারের। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ করেননি, বরং শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি অক্ষুণ্ন রাখতে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাজ করেছেন। তার অবদান আজও বাংলাদেশের মানুষের মনে বেঁচে আছে এবং তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দেওয়া সব শহীদের প্রতীক হয়ে আছেন।

তিনি ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তবে তার অবদান আজও সজীব। তার নাম শহীদ জননী হিসেবে জাতির মনে চিরকাল ধরে থাকবে। তার সাহস, দৃঢ়তা এবং সত্যের প্রতি তার ভালোবাসা, আমাদের জাতির ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ।

জাহানারা ইমামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • জাহানারা ইমামের স্বামী, এম.এ. হান্নান, ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক নেতা। তবে, পরিবারের রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য কঠোরভাবে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
  • তার ছেলে শফিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ার আগে, তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
  •  ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে গণ্য করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে।
  • জাহানারা ইমাম তার লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কাজ করেছেন এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছেন।

জাহানারা ইমামের জীবন সত্যিকার অর্থে এক অবিস্মরণীয় গাথা, যা শুধু মাতৃত্বের প্রেম নয়, বরং দেশের জন্য এক গভীর ভালোবাসারও সাক্ষ্য দেয়।