দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে আমরা অনেক সময়ই এমন কিছু খাবার গ্রহণ করি, যেগুলোর প্রকৃত উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। তেমনই একটি খাবার হচ্ছে টক দই। এটি বাংলার গ্রামীণ পরিবার থেকে শুরু করে শহরের আধুনিক ডাইনিং টেবিল সর্বত্র আজও সমান জনপ্রিয়।
স্বাদের কারণে অনেকেই এটি পছন্দ করেন, কিন্তু এর স্বাস্থ্য উপকারিতার পরিমাণ যে কতটা বিস্তৃত, তা অনেকেরই অজানা। চলুন জেনে নেওয়া যাক, টক দই কীভাবে আমাদের শরীর, মন ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
১. প্রাকৃতিক প্রোবায়োটিকের উৎস
টক দই মূলত দুধ থেকে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া একটি ফারমেন্টেড খাদ্য। এতে উপস্থিত থাকে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়িয়ে হজম শক্তি উন্নত করে।
২. হজম প্রক্রিয়া সহজ করে
যেসব ব্যক্তি অ্যাসিডিটি, গ্যাস কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো পীড়াদায়ক রোগে আক্রান্ত তাদের জন্য টক দই হতে পারে একটি স্বাভাবিক ও কার্যকরী সমাধান। এটি মানুষের হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
৩. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক
টক দইয়ের প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত টক দই খাওয়ার ফলে শরীর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে অধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বিষেশজ্ঞদের মতে, প্রোবায়োটিক খাদ্য গ্রহণ করলে অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় থাকে, যা আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধের প্রথম লাইন হিসেবে কাজ করে।
৪. হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে
টক দইয়ে থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস, যা হাড় এবং দাঁতের গঠন সুদৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও গর্ভবতী নারীদের জন্য টক দই অত্যন্ত উপকারী।
৫. হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, টক দইয়ে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এতে LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) কমে এবং HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়ে, যা হৃৎপিণ্ডের জন্য ভালো। এছাড়া, টক দইয়ের ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
যারা ওজন কমানোর চিন্তায় আছেন, তাদের জন্য টক দই হতে পারে কার্যকর একটি খাবার। এতে প্রোটিন ও কম ক্যালরি থাকায় এটি পেট ভরা রাখে দীর্ঘ সময়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
এছাড়া, হজম প্রক্রিয়া ভালো থাকলে চর্বি জমা হওয়ার ঝুঁকি কমে এবং শরীরের বিপাকক্রিয়াও সক্রিয় থাকে।
৭. ত্বক ও চুলের যত্নেও কার্যকর
টক দই শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, এটি ত্বকের যত্নেও বহুল ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েটর হিসেবে এটি ত্বকের মৃত কোষ দূর করে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে অনেকেই টক দই দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করে থাকেন।
এছাড়া, চুলে ব্যবহার করলে টক দই খুশকি দূর করে ও চুলের গোড়া শক্ত করে।
৮. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
টক দইয়ে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও কম কার্বোহাইড্রেটের উপস্থিতি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
তবে, মিষ্টি দই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ নয়।
টক দই এমন একটি খাদ্য উপাদান, যা স্বাস্থ্যরক্ষার পাশাপাশি আমাদের বহু প্রাচীন খাদ্য ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমানের ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির ভিড়ে প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে।
নিয়মিত টক দই খাওয়ার অভ্যাস শরীরের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি এটি হতে পারে স্বাস্থ্যের এক স্বাভাবিক রক্ষাকবচ। তাই এই প্রাচীন উপকারী খাদ্যটিকে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় স্থান দেওয়া উচিত- সুস্থ জীবনের পথে এক ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে।