সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে তাজা মাছ সহজেই পচে যায়। খাদ্য সংরক্ষণের এক প্রাচীন পদ্ধতি হল খাদ্য শুকানো। শুঁটকি বা মাছকে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ তেমনই একটি পদ্ধতি। মাছকে রোদে রাখা হয় পানি অপসারণের জন্য।
কারণ পানির কারণেই বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব বেঁচে থাকে এবং মাছকে পচতে সহায়তা করে। খোলা জায়গায় বাতাস এবং রোদ ব্যবহার করে মাছকে শুকানোর প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।
সাধারণত মাছ থেকে পানিকে বাতাস, রোদ, ধোঁয়া ইত্যাদির সাহায্যে শুকানো হয় কিন্তু বরফ দ্বারা শুকানো পদ্ধতিতে খাদ্যকে প্রথমে বরফ করা হয় তারপর পানি বের করা হয়। ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট ও মোল্ড বেড়ে ওঠার জন্য পানি প্রয়োজন এবং পানিকে পরিপূর্ণ রূপে শুকানো হলে খাদ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব।
শুঁটকি আমাদের খাদ্যতালিকার একটি জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর উপাদান। এটি স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর।
শুঁটকির পুষ্টিগুণ
প্রোটিনের ভান্ডার: শুঁটকিতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকে, যা দেহের পেশি গঠন, কোষের পুনর্গঠন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।
ক্যালসিয়াম: শক্ত হাড় ও দাঁতের জন্য ক্যালসিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর শুঁটকি এই খনিজের দারুণ উৎস।
আয়রন: রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক রাখতে আয়রন অপরিহার্য, যা শুঁটকি সরবরাহ করে।
ফ্যাটি অ্যাসিড: হৃদরোগ প্রতিরোধ, মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং প্রদাহ কমাতে ওমেগা-৩ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আর শুঁটকিতে এ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।
ভিটামিন ডি এবং বি কমপ্লেক্স: ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বি ভিটামিনসমূহ শরীরের শক্তি উৎপাদনে এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যক্রমে সাহায্য করে।
ফসফরাস ও পটাশিয়াম: দেহের বিভিন্ন কোষীয় কার্যক্রম এবং ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য রক্ষায় খনিজগুলো জরুরি এবং শুঁটকিতে এদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে প্রচলিত শুটকির ধরন
সমুদ্রের শুঁটকি
লইট্যা শুঁটকি: সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাগর থেকে ধরা হয়।
চিংড়ি শুঁটকি: ছোট বা মাঝারি আকারের সামুদ্রিক চিংড়ি শুকিয়ে তৈরি।
রূপচাঁদা শুঁটকি: দামি ও সুস্বাদু।
ভেটকি (বাঁশপাতা) শুঁটকি: স্বাদে মিষ্টি ধরনের।
কাটলফিশ/স্কুইড শুঁটকি: কিছু উপকূলীয় এলাকায় জনপ্রিয়।
নদীর শুঁটকি
পুঁটি শুঁটকি: নদীর ছোট মাছ, গ্রামবাংলায় খুব পরিচিত।
মলা শুঁটকি: ছোট আকারের, বিশেষ করে ভুনা বা ভর্তা বানানোর জন্য আদর্শ।
টেংরা শুঁটকি: স্বাদে ঝাঁজালো ও চমৎকার।
বোয়াল শুঁটকি: বড় মাছ শুকিয়ে বানানো হয়, দামও তুলনামূলক বেশি।
হ্রদ ও বিলের শুঁটকি
চাপিলা শুঁটকি: বিল ও হাওর অঞ্চলের মাছ।
গুঁড়া মাছের শুঁটকি: হাওর অঞ্চলের ছোট ছোট মাছ শুকিয়ে বানানো হয়।
শুঁটকি বিষয়ে ইসলামের বিধান
শুঁটকি মূলত এক প্রকার প্রক্রিয়াজাত মাছ, যা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এটির প্রধান বিশেষত্ব হলো এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণযোগ্য। ইসলামি শরিয়তে মাছকে হালাল প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ‘তিনিই সমুদ্রকে (তোমাদের) অধীন করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা গোশত আহার করতে পারো (সুরা নাহল)।’
ভালো শুঁটকি চেনার উপায় কী
খাঁটি ও ভালো মানের বিষমুক্ত শুঁটকি হবে শক্ত, চাপ দিলে ভাঙবে না। চকচক করবে না। আর শুঁটকির ওপরে সাদা কোনো গুঁড়ার আস্তর থাকবে না। স্বাভাবিক গন্ধ থাকবে প্রতিটি শুঁটকিতে।
শুঁটকির উপকারিতা
উচ্চমাত্রার প্রোটিন সরবরাহ করে : শুঁটকিতে প্রচুর প্রোটিন থাকে, যা দেহের পেশি গঠন, কোষ পুনর্গঠন এবং ক্ষত সারাতে সহায়ক। যারা দৈনন্দিন কার্যক্রমে শারীরিক শ্রম করেন, তাদের জন্য শুঁটকি দারুণ পুষ্টিকর।
হাড় ও দাঁত মজবুত করে : শুঁটকিতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায় এবং দাঁতকে শক্ত রাখে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের জন্য এটি উপকারী।
রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে : শুঁটকিতে প্রচুর আয়রন থাকে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার ঝুঁকি কমে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় : শুঁটকিতে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় : শুঁটকিতে থাকা ভিটামিন ডি ও বি ভিটামিনসমূহ দেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, নানা ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে।
মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে : ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে, মন-মেজাজ ভালো রাখতে ও ডিপ্রেশন কমাতে ভূমিকা রাখে।
কম ক্যালরি, বেশি পুষ্টি : শুঁটকি কম ক্যালরিযুক্ত, কিন্তু পুষ্টিতে ভরপুর। ফলে যারা স্বাস্থ্য সচেতন বা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাদের জন্যও এটি উপযোগী খাবার।
শুঁটকির যেমন অনেক উপকারিতা আছে, তেমনি কিছু অপকারিতাও আছে, বিশেষ করে যদি সেটা সঠিকভাবে প্রস্তুত বা সংরক্ষণ না করা হয়।
শুঁটকির অপকারিতা
অতিরিক্ত লবণ : শুঁটকি তৈরি করার সময় অনেক সময় বেশি লবণ ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
রাসায়নিক ব্যবহার : বাজারে অনেক সময় শুঁটকিতে দ্রুত শুকানোর বা পোকামাকড় ঠেকানোর জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক (যেমন ফরমালিন, কীটনাশক) ব্যবহার করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
হাইজিন সমস্যা : খোলা জায়গায় প্রস্তুত ও সংরক্ষিত শুঁটকিতে ধুলাবালি, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও বিভিন্ন দূষক মিশে যেতে পারে। এগুলো খাদ্যে বিষক্রিয়া বা পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
দুর্গন্ধ : শুঁটকির তীব্র গন্ধ অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে এবং হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যাদের ফ্যাট বা গ্যাসের সমস্যা আছে, তাদের জন্য শুঁটকি মাঝে মাঝে সমস্যা করে।
অ্যালার্জি সমস্যা : কিছু মানুষের শরীরে শুঁটকি খাওয়ার পর অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া (চুলকানি, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট) দেখা দিতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :