বর্তমান সময়ে গাঁজা শব্দটি শুনলেই স্মৃতিতে নাড়া দেয় এটা মাদক। মুখ কুঁচকে নিতে দেখা যায় অনেককেই। কিন্তু এক সময়ে এই গাঁজার অর্থেই চলছিল শহরের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ ও বিপণনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল নওগাঁর গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা। তৈরি করা হয়েছিল কো-অপারেটিভ সোসাইটি, যা গাঁজা মহল নামে পরিচিত।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী ১৯০৬ সালে বেঙ্গল প্রেসেডেন্সির নওগাঁয় ব্রিটিশ সরকার বঙ্গ অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষ শুরু করেন। ঠিক কবে থেকে প্রথম গাঁজা চাষ শুরু হয়, এর কোনো সঠিক তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় ১৮৫৭ সালে যশোর জেলা থেকে গাঁজার বীজ এনে প্রথম নওগাঁয় রোপণ করা হয়। ১৯১৭ সালে গাঁজা চাষিদের কল্যাণে গাঁজা সোসাইটি নামক একটি সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমবায় সমিতির শেয়ারের ভিত্তিতে কৃষকদের নিকট বিক্রয় করা হয়, যার ফলে কৃষকরা এর অংশীদার হয়। সে সময়ে উৎপাদন শিল্প থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য একজন রেজিস্ট্রারও নিয়োগ করা হয়। উৎপাদিত গাঁজা সংরক্ষণের জন্য একটি গুদাম তৈরি করা হয়, যেটি তৎকালীন ১৯২১ সালে বাংলার প্রাদেশিক মন্ত্রীদের অন্যতম সৈয়দ নওয়াব আলী চৈৗধুরী উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করার ফলে সরকার গাঁজা উৎপাদন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এর একবছর পরেই ১৯৭৫ সালে গাঁজা সোসাইটি তিনটি কক্ষবিশিষ্ট একটি ১,০০০ টন ক্ষমতার হিমাগার স্থাপন করেন। চুক্তি অনুযায়ী ১৯৮৭ সালে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ হলে সোসাইটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। যার ফলে সেসময় উৎপাদিত গাঁজা সোসাইটির গুদামে রেখে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
নওগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়। এর চারপাশে পড়ে রয়েছে গাঁজা সোসাইটির (গাঁজা উৎপাদন পুনর্বাসন সমবায় সমিতির) কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। শহরের প্রায় সব উন্নয়নেই গাঁজা সমবায় সমিতির অবদান রয়েছে। যেমন মসজিদ, মন্দির, সেতু। চিকিৎসা সেবায়ও অবদান রেখেছে গাঁজা সমবায় সমিতি। তবে গাঁজা উৎপাদনকারীদের সেই সোনালি সময় এখন শুধুই অতীত। অবৈধ দখল আর মামলায় জর্জরিত শত শত বছরের প্রাচীন গাঁজা উৎপাদনকারী বৃহত্তম এই সমবায় সমিতি।
ইতিহাসবিদরা জানান, মুক্তির মোড়ে গাঁজা সমিতির প্রধান অফিস ভবনটি কলকাতার রাইর্টাস বিল্ডিং এর আদলে তৈরি। নেপাল থেকে শালকাঠ এনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই ভবনটিতে এক্সাইজ সুপারিনটেনডেন্টের জন্য দোতলা বাসভবন এবং ডেপুটি চেয়ারম্যানের জন্য দোতলা ভবন নির্ধারিত ছিল।
নওগাঁর ইতিহাস গবেষক ও নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে গাঁজা সোসাইটির জন্ম। ওই সময় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষের প্রচলন ছিল। ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সাত হাজারের বেশি চাষি মিলে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ করা হতো। এবং নওগাঁর গাঁজা চাষিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায়য় সমিতি লিমিটেড। একসময় আসাম, উরিষ্যা, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই এমনকি লন্ডনেও গাঁজা উৎপাদন করা হতো। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো প্রায় ৬৬ লাখ টাকা’।
সাধারণত জুন-জুলাই মাসে গাঁজা চাষের জন্য চারা তৈরি করে ৯-১০ ইঞ্চি দূরে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাসে গাঁজা পরিপক্ব হয়। এরপরে গাঁজার জোটাগুলো পুলিশ পাহারায় নওগাঁর গাঁজা গোলায় পাঠানো হতো।
বর্তমানে নওগাঁ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে কার্যালয়ের মধ্যে গাঁজার চারটি গুদাম রয়েছে। যার কারণে এ এলাকা এখনো গাঁজা গোলা নামে পরিচিত। চারটি গুদামে এখনো ২২৬ মণ গাঁজা সংরক্ষিত আছে, যা সিলগালা করে রাখা হয়েছে। এ জমির মালিক এখন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সরাসরি বাস ও ট্রেনে নওগাঁ যাওয়া যায়। বাসে যেতে চাইলে গাবতলী বা মহাখালী থেকে শ্যামলী, হানিফ, এসআর, কেয়া, টিআর এবং মৌ এন্টারপ্রাইজে যেতে পারেন। এসি, নন-এসিভেদে এসব বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। আর ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বেশকিছু ট্রেন চলাচল করে। লালমনি এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে সান্তাহার যেতে হবে। এসি, নন-এসিভেদে এসব ট্রেনের সিট ভাড়া ৩০০ টাকা থেকে ১০৬৫ টাকা। এরপর সান্তাহার স্টেশনে নেমে অটোরিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চড়ে নওগাঁ শহরে যেতে হবে। সেখান থেকে চলে যাবেন ব্রিটিশদের তৈরি গাঁজা সোসাইটিতে।
যেখানে থাকবেন: বেশকিছু মধ্যম মানের হোটেল রয়েছে। যেখানে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় থাকতে পারবেন।
কি খাবেন : নওগাঁর বিখ্যাত খাবার প্যারাসন্দেশ, যা শহরের মিষ্টির দোকানেই পাবেন। খেতে পারেন সাব্বিরের বিরিয়ানি।
যদিও ভ্রমণ, রয়েছে দাবি
লেখক ও গবেষক মো. খোসবর আলী জানান, প্রধান দপ্তরের ভবনসহ এই সমিতির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে ৪০ একর জমি রয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁ জেলার ইতিহাস এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল আলমের এক প্রবন্ধে (রবীন্দ্র জার্নাল, সংখ্যা-১৫,২০১৩) এর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু গাঁজা সোসাইটির বর্তমান সম্পত্তির তথ্য জানতে চাইলে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে মো. অনিসুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান আনুমানিক ২৬ একরের মতো সম্পত্তি আছে। তার মধ্যে ২৮টি বাসা, একটি হিমাগার, ৬টি পুকুর, মুক্তির মোড়ের মূল ভবনসহ আশপাশের সম্পত্তি। তিনি আরও বলেন, আমি ১৯৮০ সাল থেকে নিউট্রিশন পদে কর্মরত ছিলাম। এই দীর্ঘসময় থাকার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মায়া হয়েছে। যার ফলে বর্তমান নামমাত্র ভাতা পেয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছি। আমাদের ভবিষৎ কী তা জানি না। কর্তৃপক্ষ যেন আমাদের দিকে নজর দেয় এমনটাই প্রত্যাশা’।
প্রকৃত শেয়ার হোল্ডারদের ন্যায্য দাবি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে আন্দোলনকারী জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এস এম আজাদ হোসেন মুরাদ দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে নওগাঁয় যখন বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষ হতো তখন নওগাঁর মানুষের একটা সোনালি সময় ছিল। ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করার পর ১৯৮৭ সালে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। এতে গাঁজা চাষিরা চরম বিপাকে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে চলছে এই সমিতি। অ্যাডহক কমিটি ভেঙে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে প্রকৃত শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে সমিতির সম্পদ এবং অর্থ বণ্টন করে দেওয়া হোক। তা নাহলে অবৈধভাবে অনেক সম্পদ হারিয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরে দেখা যাবে, যতটুকু রয়েছে তাও শেষ হয়ে যাবে’।
নওগাঁ জেলা সমবায় কর্মকর্তা খোন্দকার মনিরুল ইসলাম দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেকদিন থেকে অ্যাডহক কমিটি এই সমিতি পরিচালনা করছে। আমি শুনেছি অতীতে নাকি অনেক সম্পত্তি ক্ষমতাশীলদের দখলে চলে গেছে। তবে আমি আসার পর থেকে এমন কার্যক্রম হয়নি। আমাদের অফিস সংলগ্ন যে অফিসটিকে অফিসার্স ক্লাব করা হয়েছে, এটি আমাদের সম্পত্তি। যা লিখিত আকারে সমবায়ের নামে আছে। ৫ আগস্টের পর আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে তাদের সাইনবোর্ড (অফিসার্স ক্লাব) খুলে ফেলা হলেও পুনরায় তারা আবার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়’।
আপনার মতামত লিখুন :