ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

নতুন সাজে ঢাকেশ্বরী

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৪, ০৫:১৭ পিএম

নতুন সাজে ঢাকেশ্বরী

ছবি: সংগৃহীত

শারদীয় শুভেচ্ছা! বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব ‘দুর্গাপূজা’ এসে গেছে। দেবী দুর্গার আগমনে ঢাকের বোল আর ধুনুচি নাচে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী দুর্গা অশুভ শক্তির বিনাশক ও শুভ শক্তির প্রতীক। দুর্গাপূজা ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। এই পূজা কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাঙালির সামাজিক মিলনমেলাও বটে।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, মহালয়ার মাধ্যমে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন শুরু হয় এবং ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজা। এই সময়টায় দেবী মর্ত্যে তার সন্তানদের নিয়ে পিতৃগৃহে আসেন। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমীতে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়া দশমীতে দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়, এবং প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

দুর্গাপূজা সারাদেশের প্রতিটি দুর্গা মন্দিরে জমকালোভাবে পালিত হয়, যেখানে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ভক্তিমূলক পরিবেশ বিরাজ করে। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরও এই উৎসবের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তাই প্রতিবছরের ন্যায় এবছরের পূজায়ও নতুন সাজে সেজেছে ঢাকেশ্বরী।

ঢাকেশ্বরী মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠগুলির একটি। বলা হয়ে থাকে, এখানে সতীর মুকুটের মণি পড়েছিল। এই মন্দির ঢাকার অন্যতম প্রধান ও পুরাতন হিন্দু মন্দির। এটি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মন্দিরের প্রধান দেবী হচ্ছেন ঢাকেশ্বরী, যিনি দুর্গারই এক রূপ। দুর্গাপূজার সময় এখানে ভক্তদের ঢল নামে,এই মন্দির হয়ে ওঠে ভক্তদের মিলনমেলা। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে দুর্গার মূর্তির পূজা করা হয়, এবং সারা মন্দির প্রাঙ্গণ সজ্জিত হয় রঙিন আলোকসজ্জায়। এই মন্দিরে সারাবছর নানা ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়, তবে দুর্গাপূজার সময় এখানে বিশেষ আয়োজন করা হয়, যা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দুর্গোৎসবের সময় এখানে সারা দিন ধরে ভক্তরা পূজা, আরতি, এবং  প্রসাদ বিতরণে অংশগ্রহণ করেন। ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভক্তিমূলক পরিবেশ এবং ঢাকের বাদ্যের শব্দ মিলিয়ে মন্দিরে এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের এই দুর্গাপূজা ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকে আলাদা গুরুত্ব বহন করে, কারণ এখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারি এবং সামাজিক স্তরের ব্যক্তিত্বরাও উপস্থিত থাকেন।
এই মন্দির শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। ধারনা করা হয়, ঢাকার নামকরণও সম্ভবত এই মন্দিরের নাম থেকেই হয়েছে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সঠিক সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রচলিত ধারণা অনুসারে, এটি ১২ শতকের শেষের দিকে সেন রাজবংশের বল্লাল সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের নাম ‘ঢাকেশ্বরী’ এসেছে ‘ঢাকার ঈশ্বরী’ শব্দ থেকে, যা ঢাকার রক্ষাকর্ত্রী দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।  ১৯৪৮ সালে এই মন্দিরের দেবী ঢাকেশ্বরীর ৮০০ বছরের পুরোনো মূল মূর্তিটি দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় আক্রমণ এবং লুন্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করতে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা থেকে কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকা মূর্তিটি মূল মূর্তির প্রতিরূপ। তবুও এই মন্দির দীর্ঘকাল ধরে ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এবং এর পরবর্তী সময়ে মন্দিরটি বেশ কিছু প্রতিকূলতা  পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো এটি ভক্তদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। একসময় ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে ঢাকার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, এবং এ কারণে এই মন্দিরকে জাতীয় মন্দির হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরের বিভিন্ন সংস্কার এবং উন্নয়নের কাজও নিয়মিত চলছে। 

বর্তমানে ঢাকেশ্বরী মন্দির সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। এখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় মন্দিরে ভক্তদের ভিড় এবং ধর্মীয় উৎসাহ তুঙ্গে পৌঁছায়। এ  সময়ে  প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এখানে উপস্থিত হন দেবীর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। মন্দিরটি আজও ঢাকার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসেবে গৌরবের সাথে দাঁড়িয়ে আছে, অতীতের স্মৃতি এবং বর্তমানের ঐতিহ্যকে একত্রিত করে। পূজার সময় মন্দিরের প্রতিটি কোণ সুসজ্জিত থাকে এবং পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরি হয় এক ভক্তিমূলক পরিবেশ। উল্লেখ্য যে, এই মন্দির কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সকল ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত, এবং এটি সকলের মাঝে সম্প্রীতি এবং সহিষ্ণুতার বার্তা বহন করে।তাই ছুটির দিনে জমকালো আয়োজন উপভোগ  করতে চাইলে একা কিংবা পরিবারসহ ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক মন্দিরে।
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!