‘পৃথিবীর বাধা এই দেহের ব্যাঘাতে, হৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতে’ চরণটি জীবনানন্দের কবিতার লাইন হলেও বাস্তবতা এর চেয়ে অভিন্ন নয় বরং জীবনের ক্ষণে ক্ষণে বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় এর চেয়ে ভয়াবহ রূপে। কিন্তু হেরে যাওয়ার জন্য তো মানুষের জন্ম হয়নি, তারা ব্যর্থ হবে, যুদ্ধ করবে তারপর একসময় জয়ী হবে। তেমন স্বপ্ন নিয়েই বেড়ে উঠেছেন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সদর ইউনিয়নের চন্দ্রখানা গ্রামের সন্তান মানিক রহমান। জন্ম থেকেই তার দুই হাত নেই কিন্তু ছিল স্বপ্নের ডানা আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি। সেই ইচ্ছাশক্তি আর মা-বাবার ভরসার ওপর ভর করেই পেয়েছেন একের পর এক সফলতা। পা দিয়ে লিখেই নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পেয়েছেন গোল্ডেন জিপিএ-৫ এবং ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার তীব্র চেষ্টা। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীয়া প্রতিনিধি মাহফুজার রহমানের সার্বিক সহযোগিতায় দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সাক্ষাৎকারে মানিক রহমান জানিয়েছেন তার জীবনের গল্প। তুলে ধরেছেন আরফান হোসাইন রাফি
তিনি বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমার দুই হাত নেই, দুই পা থাকলেও একটি লম্বা ও অন্যটি খাটো। এ ছাড়া জন্মের পর আমার ওপরের ঠোঁট, নাক, মুখ, দাঁত স্বাভাবিক আকৃতির ছিল না; খেতে পর্যন্ত পারতাম না! যার জন্য আমার মা-কে অশালীন ভাষার শিকার হতে হয়েছে। কেউ কেউ অপয়া অলক্ষ্মী বলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। এরপর আমার বয়স যখন তিন থেকে চার তখন আমার একটা অপারেশন করানো হয়। আলহামদুলিল্লাহ সে অপারেশন সফলভাবে শেষ হলে চেহারা সাধারণ আকৃতিতে ফিরে আসে। কিন্তু আমার হাত না থাকায় ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মা-বাবার সব সময়ই একটা চিন্তা ছিল। সেই চিন্তা আরও গাঢ় করত লোকসমাজ। তাদের অকথ্য ভাষা আর সহ্য করতে না পেরে, একসময় আমার মা আমাকে জেদ করেই পায়ে কলম ধরিয়ে দেন। শুরু হয় আমার স্বপ্নের পথচলা। এরপর থেকে বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে মা-বাবার স্বপ্নকে সফল করতে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে যাচ্ছি। শিক্ষাজীবনের শুরুটা কিছুটা কঠিন ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে শিক্ষক-বন্ধুবান্ধবদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং সহযোগিতা আমার পথটা অনেক সহজ করেছে। মা ও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় নিজের আত্মবিশ্বাস ও মনোবলকে পুঁজি করে পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করেছি। এখন স্বপ্ন দেখছি, বুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করার। আল্লাহ যদি সহায় হয় ইনশা আল্লাহ আমি পারব।’
এ বিষয়ে মানিকের বাবা মিজানুর রহমান ও মা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার দুই ছেলের মধ্যে মানিক বড়। মানিক যে শারীরিক প্রতিবন্ধী, এটা আমরা মনে করি না। জন্ম থেকেই তার দুটো হাত না থাকলেও ছোট থেকে আমরা তাকে পা দিয়ে লেখার অভ্যাস করিয়েছি। সমাজে অনেক সুস্থ ও স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লড়াই করে মানিক পিএসসি ও জেএসসি ও এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এটা আমাদের গর্ব। সবাই আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন সে যেন সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। সে যেন ভালো কোনো প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে।’
আপনার মতামত লিখুন :