সামনেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা। শিক্ষাজীবনের একটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়! যে অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ শিরোনাম। এবারও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন অমুকের ছেলে বা তমুকের মেয়ে। এমন খবরের শিরোনাম চোখে পড়েনি, তেমন মানুষের সংখ্যা গুটিকয়েক। কারণ, প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষা এলেই দেশের গণমাধ্যমগুলো ছেয়ে যায় এসব খবরে। আপনার মাথায়ও যদি থেকে থাকে এমন পরিকল্পনা, তাহলে ঝেড়ে ফেলুন। মার্কিন লেখক ডেল কার্নেগির মতে, ‘সফলতা পেতে অনুকরণ নয়, অনুসরণ নয়, নিজেকে খুঁজুন, নিজেকে জানুন, নিজের পথে চলুন।’ তবে আপনার পথকে কিছুটা সহজ করতে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন ২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে দিয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জের সহজ সমাধান। তুলে ধরেছেন- আরফান হোসাইন রাফি
অভিক শূর
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথমেই বলব, কোনো কিছু অর্জনের জন্য কোনো সহজ পথ নেই। পড়াশোনা সবাই করছে কিন্তু পার্থক্য কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন শিক্ষার্থী চায় যারা ভিন্নভাবে চিন্তা করে, কৌশলী এবং পরিকল্পিত। তাই পড়তে হবে কৌশল আর লক্ষ্য নির্ধারণ করে। ভর্তি পরিক্ষার্থীদের সবার আগে প্রশ্ন ব্যাংক থেকে বিগত ১০ বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করতে হবে। তারপর সেখান থেকে যেগুলো বারবার আসে সেই টপিকগুলো খাতায় নোট করে বই থেকে সবচেয়ে ভালো করে প্রিপারেশন নিতে হবে। প্রশ্ন ব্যাংক দেখে নিজের বানানো সাজেশনসহ ইউটিউব এবং কোচিংয়ের স্যারদের দেওয়া সাজেশন সমন্বয় করে বেস্ট আউট অব বেস্ট সাজেশন তৈরি করে ফলো করতে হবে। কত ঘণ্টা পড়বে, সেটা পরীক্ষার্থীর ওপর নির্ভর করে। সে যতক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে। এটা যদি ৫ ঘণ্টা হয় তাহলে শুরুতে ৫ ঘণ্টা এবং ধীরে ধীরে সেটা বাড়াতে হবে। ১ ঘণ্টা পড়ে মনোযোগ ফেরাতে ৫ মিনিট হাঁটতে পারেন। তবে অবশ্যই ৬ ঘণ্টার ঘুম ঠিক রাখতে হবে। এ ছাড়া অনেকের কোচিং করার সামর্থ্য নেই। তাদেরও ভয়ের কোনো কারণ নেই। তারা প্রথমেই একটা ভালো প্রশ্ন ব্যাংক কিনে নিজে থেকেই বিশ্লেষণ করবে এবং সাজেশন বানাবে। তারপর বিষয় অনুযায়ী ভালো মানের বই কিনতে হবে। আমি ব্যবসায় শাখার তাই আমার মতে সি ইউনিট- এর ক্ষেত্রে প্যারাগনের যেই বইগুলো আছে অ্যাডমিশনের জন্য তা খুবই ভালো। এ ছাড়া বন্ধুদের অনেক বই কেনা, বাড়তি কোচিং ইত্যাদি দেখে হতাশ হওয়া যাবে না। এগুলো চিন্তামাত্র। বাস্তবে আপনার কাছে যে বই আছে, সেগুলোই যথেষ্ট। কেউ চাইলে মুখস্ত অংশের জন্য বাংলার ক্ষেত্রে অভিযাত্রী কিনতে পারে এবং চর্চার জন্য মোবাইলে চর্চা অ্যাপের মাধ্যমে বিনামূল্যে চর্চা করতে পারবে।
জাফিকুর রহমান অমি
লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পরিশ্রম, মেধা, ভাগ্য সবকিছুর সমন্বয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, প্রথমে প্রশ্ন প্যাটার্ন নিয়ে ক্লিয়ার ধারণা নিতে হবে। তার জন্য প্রশ্ন ব্যাংক বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর যে টপিক বেশি আসে, সেগুলো নোট করে সে অনুযায়ী পড়তে হবে। পড়া, পড়া এবং পড়া ছাড়া বাকি সব চিন্তা বাদ দিতে হবে। কী হবে, না হবে-এসব ভাবাই যাবে না। এখানে লেগে থাকাটাই বেশি কাজে দেবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে জাবির ভর্তি পরীক্ষা, প্রশ্ন প্যাটার্ন সবকিছুতেই ভিন্নতা আছে। তাই এখানে পড়তে হলে বিশ্লেষণটা খুব জরুরি। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা পড়া উচিত। পরীক্ষার কাছাকাছি সময়ে তা বাড়িয়ে ১৩-১৪ ঘণ্টা করতে হবে। তবে শুধু পড়লেই হবে না। পর্যাপ্ত পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট দিতে হবে। হোক সেটা অনলাইন বা অফলাইন। অত্যন্ত জরুরি কাজ ছাড়া এ সময় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো বিষয়ে আশপাশের সিনিয়রদের পরামর্শ নিতে হবে। তারা কোন কোন বই ফলো করেছেন কিংবা কয়টা রাইটারের বই ফলো করেছেন, সেগুলো জেনে পড়তে হবে। অভিজ্ঞদের পরামর্শ সব ক্ষেত্রেই কাজে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার সঙ্গে কোচিংয়ের কোনো সম্পর্ক নাই। যাদের কোচিং করার সামর্থ্য নেই তাদের বলব, কষ্ট করে কিছু বই কিনে মনোবল ঠিক রেখে পড়াশোনা করতে হবে। এই প্রযুক্তির যুগে একটু টেকনিক্যালি চিন্তা করতে হবে। আশপাশে অনেক রিসোর্স আছে, সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী কোচিং না করেই চান্স পায়, এটা মাথায় রাখতে হবে। তারা পারলে আপনিও পারবেন ইনশা আল্লাহ।
মো. ইয়াছিন ইসলাম
বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তি পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। যতক্ষণই পড়াশোনা করবে, সেটা যেন ধারাবাহিকভাবে হয়। কেউ এক দিন দিন-রাত এক করে পড়ে, পরদিন আর পড়াশোনা করল না কিংবা ঘণ্টা কয়েক পড়ল। এভাবে ছন্নছাড়া পড়াশোনা অ্যাডমিশনের সময় ভালো কিছু বয়ে আনবে না। তাই আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ২৪ ঘণ্টা থেকে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করা উচিত। বাকি থাকবে ৮ ঘণ্টা; সেখান থেকে ঘুমের জন্য বরাদ্দ থাকবে ৬ ঘণ্টা আর বাকি সময় খাওয়া এবং অন্যান্য। আমার পরীক্ষার সময় যা করতাম, প্রতিদিন পড়াশোনা শেষ করে রাত ৯টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতাম। ৩টায় উঠে পড়তে বসে সকাল ৮টা পর্যন্ত একাধারে পড়াশোনা করতাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার পড়াশোনা শুরু করতাম। এভাবে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করতাম। এই ধারাবাহিকতাটা পরীক্ষার আগ পর্যন্ত বজায় রেখেছি। অনেকে পাবলিকে সুযোগ না পাওয়ার আরেকটা বড় কারণ হলো- অনলাইনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া। তাই অনলাইনে সময় যতটা সম্ভব কম দেওয়া উচিত। দুর্বল সাবজেক্টগুলোকে বেশি ফোকাস করতে হবে এবং নতুন পড়ার সঙ্গে পুরোনো পড়াগুলো রিভিশন দিতে হবে। তাহলে এ যাত্রাপথটা অনেকটা সহজ হবে।
আব্দুল্লাহ আল নোমান রাফি
ফলিত গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
অ্যাডমিশন পরীক্ষার্থীরা মূলত দুভাবে পড়াশোনা করে; অনলাইন এবং অফলাইন। অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে যেসব টিচার আছেন, তারা হয়তো ক্লাস রেকর্ড দিয়ে থাকেন। সে ক্লাসগুলো বারবার রিপিট করে পড়তে হবে এবং সঙ্গে ঠিকঠাক নোট করতে হবে। এ ছাড়া প্রশ্ন ব্যাংক অ্যানালাইসিসের কোনো বিকল্প নেই। পরীক্ষার বিষয়টি সব সময় মাথায় রেখে নিজেদের মতো রুটিন করে কমপক্ষে ১২-১৪ ঘণ্টা পড়তে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে টার্গেট নিতে হবে, আজ যেভাবেই হোক আমাকে এ সাবজেক্টের এই অংশটুকু শেষ করতে হবে। এক টুকরো কাগজে সেটা লিখে নিতে হবে এবং পড়াশোনা করতে হবে। নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতে হবে, সেটা হোক অফলাইনে কিংবা অনলাইন অথবা কোনো অ্যাপস। নিজের ভুলত্রুটি নিজেই বের করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে। প্রস্তুতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিশ্রম করেই যেতে হবে। মনে রাখবেন, পরিশ্রম কখনোই বৃথা যায় না।
আপনার মতামত লিখুন :