ধানমন্ডি থেকে তেজগাঁও যাচ্ছিলাম। পথের প্রতিটি পদক্ষেপে থেমে থেমে মস্তিষ্কে একেকটি চিন্তা জন্ম নিচ্ছে। শহরের রাস্তায় চলতে চলতে মানুষের মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়, তাদের প্রতিটি মুখের পেছনে এক একটি গভীর গল্প লুকিয়ে আছে। যেতে যেতে ফার্মগেট ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশপাশে দেখে ভাবলাম, শহরের গাঢ় কোলাহলে মানুষের জীবন কত বিচিত্র হয়ে ওঠে।
ওভারব্রিজে কিছু ভিক্ষুক চোখে পড়লো। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। তাদের প্রত্যেকের ভিক্ষা করার ধরন ভিন্ন। প্রথমে এক অন্ধ ভিক্ষুকের দিকে চোখ গেল। গাঢ় কাপড়ে মোড়া তার শরীর; হাতে একটি পুরোনো থালা নিয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখে কোনো দৃষ্টি নেই; তিনি নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমার মনে হলো, পৃথিবী তাঁকে আর কিছুই দেয়নি, শুধু অবলম্বন তার বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। আমি কিছু সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, যদি আমি তাঁর জায়গায় হতাম, কী করতাম? হয়তো আমিও বিশ্বকে নির্বিকারভাবে ছাড় দিয়ে নিরবে হাত বাড়াতাম; মানবতা যেন আমাকে ভুলে গেছে এই ভেবে মরে তো যেতাম না!
তার পাশেই একটি খোঁড়া ভিক্ষুক ছিল, যার এক পা ভেঙে গেছে। তিনি নির্ভয়ে জীবনকে চ্যালেঞ্জ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ভিক্ষা করার ধরন ছিল একদম আলাদা; হাত বাড়ানোর বদলে তিনি ধর্মের গান গেয়ে মানুষকে আকর্ষণ করছিলেন। এই দৃশ্য আমাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিল। যদি মানুষের দুঃখ বদলে যায়, তাহলে কি তাঁর সংগ্রামের ধরনও বদলে যেতে পারে? এবং যদি আমি তাঁর জায়গায় হতাম, তাহলে আমার জীবনে কী হত?
পাশেই এক তরুণ ভিক্ষুকও দাঁড়িয়ে ছিল। তার গায়ে পাঞ্জাবী, চোখে সানগ্লাস। অন্য ভিক্ষুকদের মতো না করে সে হাসিমুখে মানুষের কাছে গিয়ে বলছিল, ‘ভাইয়া, একটু সাহায্য করবেন? আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি!’ তার জীবনটা সবার থেকে ভিন্ন; একদিকে অর্থের চাহিদা, অন্যদিকে নিজেকে ভিক্ষুক হিসেবে প্রকাশ না করার এক অদ্ভুত পদ্ধতি। এই দৃশ্য দেখে আমি নিজেই ভাবতে শুরু করলাম, যদি আমি ভিক্ষুক হতাম তাহলে কি আমার জীবন খুব সহজ হয়ে যেত? কী সহজে মানুষের সাহায্য পাওয়া যায়!
এই ভাবনাগুলো আমাকে একটি নতুন তত্ত্বে নিয়ে গেল। জীবন আসলে কোথায় থামে? আমাদের অস্তিত্ব কি শুধু উপার্জনের জন্য? বাস্তবে আমাদের সুখের জন্য শুধু উপার্জন নয়, নিজের অবস্থানে থেকে একটা স্থিরতা, শান্তি খুঁজে নেওয়াই প্রকৃত আনন্দ। ভিক্ষুকদের জীবনকে দেখে বুঝলাম, পৃথিবী আমাদের যা দিয়েছে তার সঙ্গে আমাদের জীবনকে মেনে নিয়ে সুখী হতে শিখতে হবে। সুখ কোন অবস্থায় নয়, সুখ আমাদের মানসিক অবস্থানে
যতটা ভাবতে লাগলাম ততটাই মনে হলো, সত্যি! জীবনকে শুধু ধন-সম্পদ বা বাহ্যিক বিষয় দিয়ে বিচার করা ভুল। আমাদের মাঝে এমন শান্তি থাকা উচিত, যেন আমরা যেখানেই থাকি সেখানে থেকে আনন্দ খুঁজে নিতে পারি। ভিক্ষুকরা, যারা জীবনকে অনেকাংশে মেনে নিয়ে ভিক্ষা করছে, তারা হয়তো নিজের ভেতরে এক ধরনের শান্তি পেয়ে গেছে। তাদের সামনে যে দুঃখের মূর্তি দেখায়, তা তাদের কেবল শিখিয়েছে যে, সুখের আসল মুল্য অন্য কোথাও নয়, এটি একান্তভাবে আমাদের মনের মধ্যে।
দিন কেটে গেছে, এখন আর তেজগাঁও যাবো কি না ভাবছি...
আপনার মতামত লিখুন :