শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৪, ০১:১৬ পিএম

প্রিয় নদী নির্বাচন করতে হবে

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৪, ০১:১৬ পিএম

প্রিয় নদী নির্বাচন করতে হবে

ছবি: মো. আবদুল বাতেন

বাংলাদেশকে একসময়ে বলা হতো নদীর দেশ; জলরাশির অনবদ্য সৌন্দর্যে ভরা এক ভূখণ্ড। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ সহস্রাধিক নদীর বুকে ছিল জলে খেলা করা নৌকাবাইচ, ছিল সবুজের স্নিগ্ধতা আর প্রাণের মেলবন্ধন। নদীগুলো যেন বাংলার রক্তধারা, যে রক্তধারায় একদিন সেচ দেওয়া হতো ফসলের জমি, ভরতো মানুষের তৃষ্ণা, চলত নৌ-ব্যবসা, গড়ে উঠত বসতি। এই নদীগুলো ছিল এ দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। কিন্তু আজকের বাস্তবতায়, এই নদীসমূহই সংকটে। নদীর সংখ্যা এবং সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি, অব্যবস্থাপনা, দখল, দূষণ এবং প্রাকৃতিক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটার কারণে নদীগুলো ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। এই সংকট শুধু পরিবেশ নয় বরং আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মহাসংকট সম্পর্কে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন নদী গবেষক এবং নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ রোকন। তার মতামতগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রথমত, বাংলাদেশের নদীগুলোর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে দীর্ঘদিন ধরে যে বিভ্রান্তি চলছে, তা এই সংকটের একটি বড় কারণ। শেখ রোকনের মতে, বাংলাদেশে নদীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবের মধ্যে ব্যাপক অমিল রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, প্রথমে দেশে ৩১০টি নদী ছিল, পরে এটি ৪১০টিতে আপডেট করা হয়। সিজিআইএস থেকে বলা হয় ৪৪৫টি নদী রয়েছে, আর জাতীয় নদী রক্ষা কমিটি সর্বশেষে ১০০৮টি নদীর হিসেব দেয়। অন্যদিকে, রিভারাইন পিপলের গবেষণায় এই সংখ্যা ১৩০০-এরও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। এই বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, নদীর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেশে নেই। ১৮৬৪ সালে ক্যানেল অ্যাক্ট থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের পানি আইন পর্যন্ত ৩১টি আইনবিধি থাকা সত্ত্বেও কোথাও নদীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। সংজ্ঞার অভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মাপকাঠি অনুযায়ী নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করছে। যেমন, কোনো স্থানকে খাল, লেক বা নদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারায় হিসেব নির্ধারণে অসংগতি দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার পুরোনো দোলাই নদীকে একসময় বিশাল নদী ধরা হলেও পরে সেটিকে খাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সমস্যা নিরসনে একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

শেখ রোকন বলেন, নদী সংকট আজ কেবল নদীর সংখ্যা বা সংজ্ঞা নির্ধারণের সমস্যায় আটকে নেই, বরং আন্তর্জাতিক সীমান্তের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর হিসাব নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বীকৃত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর হিসাব থাকলেও, রিভারাইন পিপলের গবেষণায় এর সংখ্যা ১২৩টি অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি বলে জানান তিনি। এসবের মধ্যে অনেক নদী মৌসুমি হয়ে উঠেছে; যাতে বর্ষার মৌসুমে স্রোত থাকলেও শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ প্রায় থাকে না বললেই চলে।

 

বাংলাদেশের নদীগুলোর সংকট আরও গভীর হয়েছে কারণ এই সংকটগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংকটের চেয়ে ভিন্ন। শেখ রোকনের মতে, নদী সংকটের ছয়টি সাধারণ কারণ বিশ্বজুড়ে লক্ষ্য করা যায়: প্রবাহস্বল্পতা, ভাঙন, দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন, এবং সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। তবে বাংলাদেশে এই ছয়টি সংকট একসাথে বিদ্যমান, যা অন্য কোনো দেশে বিরল। অন্য দেশগুলোতে নদী সংকট এক বা দুইটি কারণের জন্য হলেও বাংলাদেশের নদীগুলোর ক্ষেত্রে সমস্ত কারণগুলোই বিরাজমান। এটি একটি ভয়াবহ সংকেত এবং দেশের নদীগুলোর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
শেখ রোকন নদী রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তার মতে, সরকারের পক্ষে একাই দেশের সবগুলো নদীর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘কেউ একটি গ্রামের রাস্তা দখল করতে এলে যেমন গ্রামের মানুষ সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য বসে না থেকে আগে নিজেরা প্রতিরোধ করে, তেমনিভাবে নদী রক্ষায়ও স্থানীয় জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।’ এটি বোঝা প্রয়োজন যে নদী রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য হয় মানে তা জনগণের সম্পদ। জনগণ যদি নিজেদের নদী রক্ষায় সচেতন হয়, তবে নদী দখল ও দূষণ রোধ সহজতর হবে। শেখ রোকনের মতে, নদী রক্ষায় জনগণকেই প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে।  তরুণ প্রজন্মকে নদী রক্ষায় ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করার গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেছেন। বর্তমান সময়ে তরুণদের নদী সম্পর্কিত জ্ঞানে উন্নতি প্রয়োজন। শেখ রোকনের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নদী সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও তা শুধুমাত্র বিখ্যাত নদীগুলো সম্পর্কে থাকে। তিনি মনে করেন, প্রতিযোগিতা বা সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় নদীগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তরুণরা যদি নিজেদের এলাকার নদীগুলো সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে, তবে নদী রক্ষায় তাদের ভূমিকা আরও কার্যকর হবে।

নদীর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আবারো জনগণের মধ্যে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে শেখ রোকন বলেন, ‘যেমন রাস্তাঘাট বা ইন্টারনেট বন্ধ হলে মানুষের অস্থিরতা দেখা দেয়, তেমনি নদীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারলে মানুষের সচেতনতা বাড়বে।’ অতীতে মানব সভ্যতার গড়ে ওঠা নদীগুলোর সান্নিধ্যে হয়েছিল, অথচ বর্তমানে মানুষ নদীর গুরুত্ব হারাতে বসেছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই নদীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়ে দেওয়া গেলে জনগণ নদী রক্ষায় উৎসাহিত হবে।

নদী রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সফল আন্দোলনের উদাহরণও তিনি তুলে ধরেছেন, যা এই সংকট মোকাবিলায় জনগণকে সাহস যোগাতে পারে। প্রথম উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন বড়াল নদীকে, যেটি রাজশাহী, নাটোর, পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রবাহিত। দীর্ঘদিন যাবত এই নদীটি বিভিন্ন কারণে শুকিয়ে যাচ্ছিল। এস এম মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে বড়াল রক্ষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে রিভারাইন পিপলের গবেষণার ভিত্তিতে সরকার এই নদী পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে নদীটির স্রোত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয় উদাহরণটি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের আদী যমুনা নদী, যেখানে একটি কালভার্ট নির্মাণের ফলে নদীর স্রোত বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। আশেকে এলাহীর নেতৃত্বে নদী রক্ষা আন্দোলনের ফলস্বরূপ এই নদীর প্রাকৃতিক স্রোত আবারও সচল করা সম্ভব হয়। এ ধরনের স্থানীয় জনগণ এবং নেতৃত্বের সংহত কার্যক্রম নদী রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তৃতীয় উদাহরণ হলো কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটের চাকিরপশা নদী, যেটি চাষাবাদ এবং মৎস্য চাষের জন্য লিজ দেওয়া হয়। এই নদীটির অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য তুহিন ওয়াদুদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নদীটির প্রাকৃতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। 
শেখ রোকনের মতে, এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের নদী রক্ষায় সফলতার উদাহরণ হতে পারে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তরুণ প্রজন্মের জন্য শেখ রোকন তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন যা তাদের নদী রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে। প্রথমত, তরুণদের নিজেদের প্রিয় নদী নির্বাচন করতে হবে, যেভাবে তারা প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা শিল্পীকে চেনে। এটি নদীর প্রতি তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, তরুণদের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রিয় নদী নিয়ে আলোচনা করা, সচেতনতা তৈরি করা এবং নদী রক্ষায় উৎসাহিত করা উচিত। তৃতীয়ত, তরুণরা নিজেদের প্রিয় নদী নিয়ে লেখালেখি করে এমন ব্যক্তিদের সাথে গ্রুপ তৈরি করতে পারে। এভাবে তারা দলবদ্ধভাবে নদী রক্ষা আন্দোলনে অংশ নিতে পারবে।
নদী রক্ষায় এই সংকট কাটিয়ে উঠতে শেখ রোকনের মতামতগুলো সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় তরুণদের উদ্যোগ এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি। নদীগুলো কেবল পানি বা পরিবেশের অংশ নয়; এগুলো দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সমাজ ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নদীগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে জনগণ সচেতন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি প্রাণবন্ত ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!