গল্পটা এমন এক শহরের, যেখানে আলু ছিল মানুষের প্রাণ। সকালে আলুর ভর্তা, দুপুরে আলুর দম, রাতে আলুর তরকারি আলু ছাড়া যেন মানুষ বেঁচে থাকার কল্পনাই করতে পারত না। একদিন হঠাৎ শহরের বাজারে আলুর দাম বেড়ে গেল। না, বেড়ে গেল বললে কম বলা হবে আলু এমন এক পণ্য হয়ে উঠলো, যেটা কিনতে গিয়ে মানুষ দাসী বেচার চিন্তা করতে লাগল।
শহরের কেন্দ্রীয় বাজারে ছিল ‘লালন মিয়া আলু স্টোর।’ লালন মিয়া একসময় আলু বিক্রি করতেন, এখন তিনি নিজের দোকানকে ‘আলুর রাজ্য’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিদিন বাজার খোলার আগে তার দোকানের সামনে এক বিশাল লাইন। কেউ হাত জোড় করে, কেউ আবার কাঁধে বোঝা নিয়ে হাজির হয়। মনে হয় যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি!
একদিন সকালবেলা রমিজ চাচা বাজারে গেলেন। হাতে একটা পুরোনো ব্যাগ, আর মুখে এমন দৃঢ় সংকল্প যেন আলু কিনেই ফিরবেন। কিন্তু বাজারে গিয়ে চাচা দেখলেন, লাইন তো মাইলখানেক লম্বা! সামনের দিকে কেউ পিকনিক মুডে কেটলি বসিয়ে চা বানাচ্ছে, কেউ লুডু খেলছে। চাচা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললেন,
এই লাইনটা কি আলু কিনতে, নাকি রসগোল্লা কিনতে?
সামনের লোকজন ঘুরে তাকিয়ে উত্তর দিল,
‘চাচা, আলু এখন রসগোল্লার থেকেও দামি! লাইনে থাকুন, নইলে আলু পাবেন না।’
চাচা লাইন ধরলেন। এক ঘণ্টা গেল, দুই ঘণ্টা গেল তখনই ঘটে বিপত্তি। পাশের দোকানের করিম মিয়ার মাইক বাজল,
লালন মিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, আজ আর মাত্র পাঁচ কেজি আলু বাকি!’
এই ঘোষণার পর যেন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। লাইন ভেঙে সবাই ছুটলো লালন মিয়ার দোকানের দিকে। চাচা পেছনে পড়ে গেলেন। কারও হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল, কারও পকেট থেকে টাকা। কেউ কেউ দৌড়াতে গিয়ে একেবারে আলুর বস্তার মতো লুটিয়ে পড়লো।
লালন মিয়া দৌড়ে দোকানের দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভেতর থেকে চিৎকার করে বললেন,
সবাই শান্ত হন! ‘আলু কিনতে হলে আগে শপথ নিতে হবে, একজন মাত্র এক কেজি নিতে পারবেন!’
লোকজন এমনভাবে মাথা নেড়ে রাজি হলো, যেন যুদ্ধক্ষেত্রের জেনারেলের কথা শুনছে। দোকানের দরজা খুলতেই প্রথমে ছুটে গেল একজন যুবক। লালন মিয়া বললেন,
‘কত কেজি নেবেন?’
যুবক উত্তর দিল,
‘আধা কেজি!’
‘আধা কেজি?’ লালন মিয়া অবাক।
‘জি, স্যার। তেল-নুনের টাকা নেই। তাই এক টুকরো আলু দিয়েই ভর্তা বানাবো।’
তারপর ঢুকলেন রমিজ চাচা। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘এক কেজি দেন। আমার নাতি আলু ছাড়া কিছু খায় না। দুই দিন ধরে ভাত খায়নি, শুধু বলছে ‘আলু! আলু!’
লালন মিয়া কেজিখানেক আলু চাচার ব্যাগে দিয়ে হাসি মুখে বললেন,
‘আলুর দাম এখন সোনার চেয়েও বেশি। এতো যত্ন করে রাখবেন যেন নাতির চেয়েও বেশি আদর পায়।’
চাচা দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পর তাকে দেখে মনে হলো যুদ্ধে জেতা এক বিজয়ী সেনাপতি। পেছনে তাকিয়ে চিৎকার করলেন,
‘দেখেছো, আমিও পেরেছি! এখন আমি আলুর মালিক!’
পাশের লোকজন এমনভাবে চাচার দিকে তাকালো যেন তিনি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একমাত্র আবিষ্কার।
সেদিন সন্ধ্যায় চাচার বাড়িতে আলুর ভর্তা হলো। সবাই এমনভাবে আলু ভাগ করে খেলো, যেন সেটা কোনো রাজকীয় মিষ্টান্ন। আর শহরের মানুষ বুঝলো, আলু শুধু শাক-সবজি নয়, এটা তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক রসিকতা, এক সংগ্রামের নাম।
আপনার মতামত লিখুন :