ঢাকা রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গণত্রাণ কেন্দ্র; বাঁধ ভেঙেছে ব্যবধানের

আরফান হোসাইন রাফি

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৪, ০৬:২৩ পিএম

গণত্রাণ কেন্দ্র; বাঁধ ভেঙেছে ব্যবধানের

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‍‍`সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই‍‍` বলেছিলেন মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের প্রখ্যাত বাঙালী কবি চণ্ডীদাস। কালের আবর্তে পৃথিবীর বিরল ইতিহাসের কলিযুগেও যা মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যাকে মায়ের হাতের নকশি কাঁথার মতো অত্যন্ত নিপুণভাবে বুনন করে রেখেছে হৃদয়ের অন্তস্থলে। ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা কিংবা যেকোন দুর্যোগে যা হয়ে উঠে সাম্যের গান। ‍‍`মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।‍‍ ‍‍`নজরুলের এই অমর আহ্বান যেন আজও অমলিন।

উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগজুড়ে বানবাসিদের আর্তনাদে যখন থমকে গেছে গোটা দেশ! বাঁধ ভেঙে মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে প্লাবিত হওয়ার সংবাদ; যেখানে রয়েছে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ খবরও। সেখানে বানবাসিদের বাঁচাতে দেখা মিলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের। ইতিহাসের বিরল এই অংশগ্রহণে এগিয়ে আসতে দেখা যায় পথের কাঙ্গাল থেকে বিত্তশালী কিংবা মন্দিরের পুরোহিত থেকে মসজিদের ইমামকে। এমনকি বাদ যায়নি, স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট শিশু থেকে মাদ্রাসার এতিম শিশুরাও। গত শুক্রবারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল তেমনই একটি ভিডিও। যেখানে দেখা যায় এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক তার থালা থেকে বন্যার্তদের জন্য বাড়িয়ে দিয়েছে তার আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এছাড়াও বন্যার্তদের সহায়তায় বাংলাদেশের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে গণত্রাণ কেন্দ্র। ঢাকার টি এস সি থেকে যার আয়োজন শুরু হয়ে একই সঙ্গে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ জেলাগুলোতেও সংগ্রহ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার তহবিল। সেই তহবিল সংগ্রহে যুক্ত ছিল তরুণ ছাত্র সমাজ থেকে সমাজের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা। এই নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সাথে কথা হয়েছে নরসিংদী জেলা মাধবদী থানার তরুণ সমাজ সেবক মোহাম্মাদ রিফাতের সাথে। তার মতে, সদ্য স্বাধীনতার জন্যই দেশের সর্বস্তরের মানুষের এমন অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছে। বাঁচার স্বাধীনতা পেলে বাংলাদেশের মানুষ সবাইকে সাথে নিয়েই বাঁচবে। তরুণ সমাজ সর্বদা দেশের কল্যাণে কাজ করছে এবং করে যাবে। যেখানে অন্যায় দেখবে সেখানেই ফুঁসে উঠবে আর দেশের ক্রান্তিলগ্নে হয়ে উঠবে বিপদগ্রস্থের ভরসাস্থল। এইভাবেই একদিন দেশ থেকে মুছে যাবে ধর্ম বর্ণের ব্যবধান।

এ বিষয়ে মাধবদী থানা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সমাজ সেবক আল-আমিন সরকার জানান, বিপদে আপদে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এদেশের মানুষের অতি পুরনো ঐতিহ্য। বাঙালি জাতি বরাবরই সুসংগঠিত ও ভ্রাতৃত্বপরায়ণ। কোনো ক্রান্তিলগ্নেই এই জাতি চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারেনি। যার উৎকৃষ্ট  উদাহরণ ৫২‍‍`র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে কয়েক দফার গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সর্বশেষ ২০২৪ এর নতুন স্বাধীনতা সংগ্রাম। প্রতিটি সফলতা সম্ভব হয়েছে এ জাতির একতাবলে। পাশাপাশি এদেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি প্রলয়ঙ্কারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে সুনামি, সিডর, আইলাসহ ৮৮, ৯৮ ও ২০০৪ এর বন্যায়ও এদেশের মানুষ দুর্গতদের পাশে ঝাপিয়ে পড়েছে। তারই অংশ হিসেবে এবারের বন্যায়ও সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বানবাসিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্তিটাও এবারের বন্যায় সবার স্বতঃস্ফূর্ততার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

‍‍`চলমান এই দুর্যোগকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো হয়ে উঠেছে মানবতার ঢাল। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী ডাকাতিয়া নদী তীরবর্তী গ্রাম চান্দেরবাগ থেকে উঠে আসে তেমনই একটি গল্প। বসবাসরত দুই থেকে আড়াইশ লোকের এই গ্রামটিতে মাত্র দুটি পরিবার মুসলিম। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পুরো গ্রামটি ডুবে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে এখানকার হিন্দুরা আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী পিপড্ডা গ্রামের মসজিদে। ওই গ্রামের বাসিন্দা গীতা রানী জানান, সংসার জীবনে ডাকাতিয়া নদীতে পানি বাড়ে আবার চলে যায় কিন্তু কখনও ঘরে পানি ঢুকেনি। এবার পুরো গ্রাম ডুবে যাওয়ায় কোনোরকম জীবন নিয়ে তারা মসজিদে অবস্থান করেছে। 

ধর্মের সঙ্গে ধর্মের এমন বন্ধনে বলাই যায়; সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে বাঁধ ভেঙে এক হয়েছে সব বাঁধা ব্যবধানের। এমন দেশকেই সবসময় চায় বাংলার সাধারাণ মানুষ; যেখানে মসজিদ, মন্দির, গির্জা থাকবে একই হৃদয়ে; মানুষ কথা বলবে মানুষের কল্যাণে।

আরবি/জেডআর

Link copied!