চারদিকে হেমন্তের হাওয়া। সবুজ পাতার মাঝে মধু আহরণে প্রজাপতি ও মৌমাছিদের উড়াউড়ি। যেন বিশেষ কোন ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা পতঙ্গের দল। তবে সেই সুবাসে যে শুধু এই পতঙ্গ বাহিনী নিজেদের চাহিদা মেটাচ্ছে, এমনটা নয়। এই তীব্র সুঘ্রাণে বিমোহিত পথচারী, এলাকাবাসীসহ পুরো নগরী।
বলছিলাম শীত মৌসুমের প্রথম শীতল হাওয়ার সাথে ফোটা, চোখ জুড়ানো ছাতিম ফুলের কথা। রাত যত বাড়তে থাকে, ততই গন্ধের তীব্রতা বাড়ে এই ফুলের। ছাতার মতো চারদিকে ছড়িয়ে থাকায় এ গাছের নাম ছাতিম।
মূলত শীতের শুরুতেই ফোটে ছাতিম ফুল। স্থানীয়ভাবে একে ‘ছাতিয়ান, ছাত্তিয়ান’ নামেও ডাকা হয়। তবে ফুলটির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি তীব্র গন্ধযুক্ত ফুল। এর ইংরেজি নাম ‘ডেভিলস ট্রি’। রয়েছে বহু ঔষধি গুণাগুণ।
সন্ধ্যার পরই রাস্তার আশপাশে বা বাড়ির পাশ থেকে যদি তীব্র গন্ধযুক্ত কোনো ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে, তবে সেটি ছাতিম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, অনেক দূর থেকেই ছাতিম ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্রাম-বাংলার রাস্তাঘাট, নদীর তীর, বসতবাড়ির অনাবাদি জায়গা, স্কুল-কলেজের পাশে এ গাছ দেখা যায়। অনেক উঁচু গাছ হয় বিধায় এর গন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত যায়।
বর্তমানে এমন ফুলের তীব্র সুঘ্রাণ খুব কম শহরে দেখা মেলে। তবে আমাদের দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর সড়কের দুই পাশে ছাতার মতো ছেয়ে আছে এই ছাতিম গাছ। রাজশাহী নগরীর রেলগেট থেকে সিঅ্যান্ডবি মোড় পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কে ৩৫০টি ছাতিম গাছ রয়েছে। আর নগরী জুড়ে রয়েছে ৫৬০টি গাছ, যেগুলো লাগিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
এই ছাতিম ফুলের গাছ একদিকে যেমন সুবাসিত করছে পুরো শহর, অন্যদিকে তীব্র রোদে পথচারীদের দিচ্ছে স্বস্তি।
স্থানীয় বাসিন্দা নুসরাত জাহান মিষ্টি বলেন, ‘পুরো নগরজুড়ে এই ছাতিম ফুল যেমন সুবাস ছড়াচ্ছে, ঠিক তেমনই এই গাছ নগরীর সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করছে।’
রাজশাহী সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সরফরাজ নওয়াজ বলেন, ‘ছাতিম ফুল আগেও দেখেছি, তবে এবছর যেভাবে একসঙ্গে সব গাছে সারি সারি হয়ে ফুটেছে তা আগে কখনো দেখিনি। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত রাস্তা সুবাসিত করে রাখে এই ফুল।’
নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারেক রহমান বলেন ‘সারাবছর শহরের বিভিন্ন স্থানে গাছ দেখতাম, ভাবতাম সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এই গাছ লাগানো হয়েছে, তবে এখন দেখছি অনেক সুন্দর ফুল হয় এই গাছে। গাছটাও যেমন সুন্দর ফুলগুলো তেমন সুবাসিত।’
রাজশাহীতে সবপ্রথম ২০১৯ সালে ছাতিম ফুলের গাছ রোপন করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। এরপর থেকে প্রতি বছরই লাগানো হয়েছে ছাতিম গাছ। সড়ক বিভাজনের পাশাপাশি সুগন্ধী এই ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে পদ্মার পাড়েও।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ উল ইসলাম বলেন, রাজশাহীতে বড় গাছের কিছুটা কমতি ছিল। তবে এই ছাতিম গাছগুলি লাগানোর ফলে সেটি লাঘব হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিরূপ প্রভাব (হিট ওয়েভ) রাজশাহী অঞ্চলে রয়েছে, এই গাছগুলি ব্যাপক হারে লাগানোর ফলে সেক্ষেত্রেও নগরবাসী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।
জানা গেছে, মিষ্টি সুবাসের পাশাপাশি ছাতিম গাছের বেশ উপকারিতাও রয়েছে। গাছটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল- এর ছাল কাটলে দুধের মতো সাদা রস বের হয়। এই রসটি ঐতিহ্যগত ওষুধ এবং রাবার উৎপাদনসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। ছাতিম গাছের কাঠের ওজন কম হওয়ায় বেশ ভালো আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। তবে, সাধারণত এ গাছ জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এই গাছের নির্যাস ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ছাতিম গাছ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ছাতিম গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছের গভীর শেকড় মাটির ক্ষয় রোধ করতে এবং মাটির গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এর ঘন ছাউনি পাখি এবং পোকামাকড়সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী প্রজাতির ছায়া এবং আশ্রয় প্রদান করে।
রাজশাহী এলাকায় চড়ুই পাখিদের অন্যতম বাসস্থান হল রাস্তার ধারের এই ছাতিম গাছগুলো। সুমিষ্ট ঘ্রাণবিশিষ্ট ফুলে আকর্ষণীয় চেহারার পাশাপাশি ছায়া প্রদানকারী গুণাবলীর জন্য ছাতিম গাছের তাৎপর্য অত্যধিক। আর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের এই উদ্যোগের বাইরেও দীর্ঘ সময় ধরে নগরীর পাড়া মহল্লায় ও অনেকের বাড়িতে সুবাসিত এই গাছ রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :