একেকজন মানুষের একেক রকম শখ বা স্বপ্ন থাকে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই শখ বা স্বপ্ন থেকে জন্ম নেয় পেশা। আবার পেশাও কখনো কখনো হয়ে ওঠে শখের একটি অংশ। ঠিক এমনই একটি গল্প উত্তরের জেলা গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার শ্রী সঞ্জিত কুমারের।
বর্তমানে, দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চলছে মহা উৎসব দুর্গাপূজা, আর পূজার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সবাই। তবে, সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মালাকার’রা, কারণ দুর্গাপূজা উদযাপন করতে হলে প্রয়োজন হয় দেবীর প্রতিমা। সেই প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা ব্যস্ত না হলে পূজা কীভাবে হবে?
শ্রী সঞ্জিত কুমার একজন মালাকার, যিনি নিজ হাতের নিপুণতায় গড়ছেন দেবী দুর্গাকে। এই ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। শ্রী সঞ্জিত কুমার জানান, ‘পূজা আসলেই প্রতিবার চারিদিক থেকে ডাক আসে, এবারও ব্যাতিক্রম হয়নি। হাতে অল্প সময়, দিনরাত এক করে কাজ করছি।’ গল্পের শুরু হয় ছোটবেলায়; তিনি শখ করে শিখেছিলেন মূর্তি বানানো। নদীর পাড়ে বসে মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করতেন খেলতে খেলতে। এভাবেই আস্তে আস্তে শিখে যান। একবার পাড়ার মন্দিরে প্রথমবারের মতো প্রতিমা বানানোর সুযোগ পান এবং প্রথম কাজেই পান মানুষের প্রশংসা। এই প্রশংসা তার জন্য ছিল এক নতুন প্রেরণা। এরপর থেকে ২৯ বছর ধরে তিনি প্রতিবারের পূজায় নিজ পাড়ার মন্দিরসহ আশেপাশের আরো কয়েক পাড়ার প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার মতে, এই গুরুদায়িত্ব পালন করা একটি গৌরবের বিষয়। তিনি বলেন, ‘প্রথমে এটা ছিল আমার শখ, কিন্তু পরবর্তীতে আমার পেশার একটি অংশ হয়ে গেছে।’ শ্রী সঞ্জিত কুমার প্রতিটি প্রতিমা তৈরির সময় তাঁর মনের সবটুকু প্রেম নিবেদন করেন। তার হাতে গড়া প্রতিমা যেন জীবন্ত। তিনি বলেন, ‘প্রতিমা তৈরির সময় আমি দেবীর উপস্থিতি অনুভব করি। মাটি থেকে আমি তাদের মুখ ফুটিয়ে তুলতে চাই, যেন তারা পূজার সময় মণ্ডপে আসা সকলের মনে ভক্তির সঞ্চার করে।’
তিনি জানান, প্রতিমা তৈরির জন্য দীর্ঘদিন পরিশ্রম করতে হয় তার। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। বিভিন্ন ধরনের মাটি, রং এবং উপকরণ ব্যবহার করে প্রতিমা তৈরি করেন তিনি। প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি, তিনি পুজার অন্যান্য আয়োজনের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। শুধু প্রতিমা তৈরি করে সারাবছরের খরচের অর্থ উপার্জন করা না গেলেও প্রতিবার পূজার সময় তিনি চলে আসেন গ্রামে। এবিষয়ে তিনি বলেন , ‘পূজা এলেই আমি অন্যান্য কাজ ফেলে গ্রামে চলে আসি। স্বপ্নের টানে মণ্ডপে মন্ডপে প্রতিমা তৈরি করি।’ তাঁর এই কাজের জন্য অনেক মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন। স্থানীয়রা বলেন তিনি সত্যিই একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী।
এদিকে, সঞ্জিত কুমারের পরিবারও তাঁর এই কর্মের জন্য গর্বিত। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা সব সময় তাঁর পাশে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার সন্তানরাও এই শখের চর্চা করুক।’ তার এই একাগ্রতা ও নিষ্ঠা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
শখ এবং পেশা কখনোই একে অপরের শত্রু নয়। বরং, সঠিক মনোভাব ও পরিশ্রমের মাধ্যমে, একটি শখকে পেশায় পরিণত করা সম্ভব। শ্রী সঞ্জিত কুমারের মতো অসংখ্য কালাকাররা আমাদের সমাজে তাঁদের নিষ্ঠা ও শ্রমের মাধ্যমে উদাহরণ স্থাপন করে চলেছেন। দুর্গাপূজা উদযাপনের এই আনন্দ ও উৎসবের পেছনে তাঁদের কঠোর পরিশ্রম রয়েছে। তাদেরকে সম্মান!
আপনার মতামত লিখুন :