নতুন বাসায় উঠেছি। চারপাশটা গুছিয়ে নিতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছি, কোনোকিছুই ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। পুরোনো মেঝে, দেয়ালে জমে থাকা ধুলো মুছতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল পুরোনো পলিথিনে মোড়ানো বইয়ের মতো কিছু। পলিথিন খুলে দেখা গেল সেটা একটা ডায়েরি। মলাট খুলতেই দেখলাম ভেতরে মোটা অক্ষরে লেখা ‘হারুনের ডায়েরি’। অদ্ভুত কৌতূহল নিয়ে পাতা উল্টাতেই বোঝা গেল, এই ডায়েরিটা একজন নিঃসঙ্গ মানুষের অবসর সময়ে তার নানা ভাবনা ও অনুভূতির কথামালা। যেন ব্যস্ত ঢাকার মাঝে হারিয়ে যাওয়া কোনো মনের নিঃশব্দ কথোপকথন। আমি পাতা ওল্টাতে থাকলাম...
আজ বৃহস্পতিবার। ঢাকার রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম, তবু বেরিয়ে পড়েছি। বেরোনোর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। কিন্তু বেকার মানুষ যখন অবসর খোঁজে, তখন যে উদ্দেশ্য ছাড়াই বেরিয়ে পড়ে। অন্যরা যেখানে কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠে, আমি সেখানে প্রতিটা দিনই ছুটির আমেজে কাটাই। হাঁটছি ধানমণ্ডি টু মিরপুর রোড ধরে। মনে হচ্ছে পথের প্রতিটি মানুষ কোনো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ছুটছে, তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া আছে। আর আমি? আমিও ছুটছি, কিন্তু কোথাও পৌঁছানো আমার উদ্দেশ্য নয়।
জ্যাম ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সামনে পড়লো একটা পাবলিক লাইব্রেরি। কৌতূহল নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢাকার লাইব্রেরিগুলোতে মানুষ পড়তে কম, ছবি তুলতে বেশি আসে। কিন্তু আমি এসেছি মানুষের ভেতরের ভিন্নতা দেখতে। লাইব্রেরির কোণে কিছু বইয়ে ডুবে থাকা লোকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া একজোড়া চোখ খুঁজে ফিরছি।
এখানে এসে বোঝার চেষ্টা করলাম, মানুষ কেন এত ব্যস্ত? বইয়ের পাতায় ডুবে আছে কিছু, মুঠোফোনে নিমগ্ন কিছু, আবার কেউ বা নিস্তব্ধতায় বসে আছে। লাইব্রেরির পরিবেশটা শান্ত, যেন হাজারো শব্দের মধ্যেও নির্জনতার মতো একটা নিস্তব্ধ ভাব। এখানে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, এই শহরের কোলাহল আর জ্যামের মতোই আমরাও কোথাও থামতে ভুলে গেছি। আমাদের পথ যেন একইসঙ্গে বয়ে চলে, আর থামার সুযোগ নেই।
লাইব্রেরিতে আমার দম বন্ধ লাগতে শুরু করল। আমি বেড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মিরপুর না গিয়ে চলে এলাম ফার্মগেটের দিকে। চারপাশে গাড়ি, রিকশা, মানুষের ভিড়। সবাই কোথাও না কোথাও যেতে ব্যস্ত। এ শহরের প্রতিটা মানুষের কোলাহলের মাঝে নিজস্ব একটা গল্প আছে। কেমন এক বিষণ্নতা যেন সবার মধ্যে বিদ্যমান, কেউ বলতে পারে, আবার কেউ বলে না। এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ লালচে মেঘে ছেয়ে গেছে, যেন আমার মনের ভেতরের এলোমেলো ভাবনাগুলো সেই আকাশেই প্রতিফলিত হচ্ছে।
এই ছুটোছুটির জীবন, এই নিরন্তর যাত্রার শেষ কোথায়? হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, এভাবে চলতে থাকার কি কোনো অর্থ আছে? নাকি আমরা কেবলই অজানা এক অভ্যাসের দাস হয়ে যাচ্ছি? হয়তো জীবনের মূল রহস্য খুঁজে পাওয়ার চেয়ে আমাদের পক্ষে এই ছোটাছুটি অনেক সহজ। আমরা ছুটছি, আবার থামতেও পারি না। ছুটতে ছুটতে একদিন হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই আমাদের গন্তব্য নয় কি?
জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে গিয়ে কি কিছুই পাব না, নাকি এই খুঁজে না পাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোনো এক অজানা উত্তর?
হারুনের ডায়েরিতে রয়েছে আরও অনেক কথা। ফুরসতে সেসব গল্প হবে...
আপনার মতামত লিখুন :