ঢাকা শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
হারুনের ডায়েরি

শূন্যতার খোঁজে

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৪, ০৪:৩৬ পিএম

শূন্যতার খোঁজে

ছবি: সংগৃহীত

মনে হচ্ছে অন্য কোনো পৃথিবীতে হাঁটছি। পায়ের নিচে নরম মাটি; হালকা স্যাঁতসেঁতে। শীতের বিকেলে গ্রামের মাটি এমনিতেই একটু কোমল থাকে। বাতাসে ভেজা ঘাসের গন্ধ। চারপাশটা নিস্তব্ধ হলেও এক ধরনের সজিবতায় ভরা। পথের ধারে কলার ঝোঁপ, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা সেসব উঠান আর পথের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু তালগাছগুলো যেন আমাকে মুগ্ধ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
পথে হাঁটতে হাঁটতে খালের ধারে কিছু বাচ্চাদের দেখলাম মাছ ধরছে। কয়েকজনের হাতে ছিপ, আরেকজনের হাতে জাল। ছিপের টোপে মাছ লাগতেই ছোট্ট একটা উচ্ছ্বাসের গুঞ্জন তৈরি হলো। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এই দৃশ্যগুলো আমার কাছে ছায়াছবির মতো লাগলো। হঠাৎ মনে হলো, জীবন তো এমনই। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলোতেই আটকে থাকে সুখ; আর আমরা শহরের লোকেরা বড় কিছু পাওয়ার নেশায় এই মুহূর্তগুলো মিস করে যাই।
সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে; কাছেই নদী। আকাশের রঙ দ্রুত বদলাচ্ছে। সূর্যাস্তের আলো নদীর জলে ঝিকিমিকি করে উঠছে। পশ্চিম আকাশে কমলা, মেরুন আর সোনালি রঙের খেলা। নদীর পাড়ে এসে একটা পুরোনো, নষ্ট ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়লাম। এখানে বসে আমার মনে হলো, সময়টা এখন থেমে গেছে। চারপাশে নীরবতা; মাঝে মধ্যে কেবল দূর থেকে দূরে চলে যেতে থাকা ট্রলারের শব্দ, আর পানির হালকা ছপছপ আওয়াজ।
এই পরিবেশটা আমাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করল। মনে হলো নষ্ট ল্যাম্পপোস্টটা যেন আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অনেক সময় আমাদের পথপ্রদর্শক অনেক কিছুই  হারিয়ে যায়; তবু আমরা চলতে থাকি। এই নষ্ট ল্যাম্পপোস্ট যেমন দাঁড়িয়ে আছে; কখনো হয়তো আলো ফিরবে। তেমনই জীবনের অন্ধকারেও কোথাও না কোথাও আলো খুঁজে পাওয়া যায়।
বসে থাকতে থাকতেই রাত গভীর হলো। ধীরে ধীরে কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে যেতে শুরু করল। আমি নদীর পাড় থেকে উঠে একটা ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে বালুচরের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ভেজা বালুতে পা রাখতেই তারা সরে যাচ্ছে। বালুর নিচে কাদার স্পর্শ পায়ের তলায় অদ্ভুত শীতলতা এনে দিল। আকাশে এক টুকরো চাঁদ এখনো দৃশ্যমান; তার আলো কুয়াশার ভেতর দিয়ে এসে মাটি ছুঁয়েছে।
একসময় খেয়াল করলাম সামনে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম, পথ হারিয়ে ফেলেছি। আশপাশে কোনো দিক নির্দেশনা নেই, নেই কোনো চেনা চিহ্ন। তবুও অদ্ভুতভাবে; ভয় পেলাম না। বরং ভালোই লাগছিল। পথ হারানোর এই অভিজ্ঞতা আমাকে জীবন নিয়ে নতুন কিছু শেখাচ্ছিল। আমরাও কি কখনো জীবনের পথ হারাই না? জীবনের ধূসর সময়গুলো কি কুয়াশার মতো নয়? আমাদের কাছে তখন কোনো দিকনির্দেশক থাকে না। তবুও আমাদের খুঁজতে হয়; হোঁচট খেতে খেতে পথ খুঁজে বের করতে হয়।
আমার কাছে কোনো আলো নেই। এই মুহূর্তে সেই অন্ধকার রাতের গভীরে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, জীবনে এমনও সময় আসে; যখন আলো ছাড়াই চলতে হয়। সেসব সময়ে আমরা আমাদের মনের ভেতরের আলো খুঁজে নিতে শিখি। এই পথ হারানোও হয়তো সেই আলো খোঁজারই অংশ।
কুয়াশার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একসময় নদীর ধারে একটা জায়গায় থামলাম। আকাশের চাঁদ ঝাপসা হয়ে এসেছে। মনে হলো চারপাশের সবকিছু ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে। চারপাশের নীরবতা একধরনের শূন্যতার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু কি অদ্ভুত! সেই শূন্যতাও আমার ভালো লাগছে।
আমি হাঁটছি, ভাবছি, হারাচ্ছি। বালুচর পেরিয়ে অদ্ভুত একটা জায়গায় এসে থেমে গেলাম। না, কোথায় এসেছি জানি না। কিন্তু এই অচেনা জায়গাটাও আমার মনে গভীর এক স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে। চারপাশের নীরবতা, ট্রলারের ক্ষীণ আওয়াজ, কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া পথ; সবকিছুই এক একটা প্রশ্ন, যার উত্তর আমার জানা নেই...
 

আরবি/ এম এইচ এম

Link copied!