স্বাস্থ্যবিধির ধার না ধেরে যখন-তখন কৃষি জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ছিটানোর কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মৃত্যুঝুঁকি। জীবনের প্রতি কোনোরূপ ভালোবাসার তোয়াক্কা না করে সহজ সরলভাবেই এসব করছেন প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকরা। তাদের সে বিষয়ে সচেতন করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা ডিএই মাঠদিবস ও বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিলেও তা কানে তুলছেন না কৃষকরা। ফলে তাদের এসব আয়োজন অনেকটাই মাঠে মারা যাচ্ছে। এমনটাই জানালেন বেশ কয়েকজন ডিএই কর্মকর্তা।
ঝিনাইদহ সদর ও শৈলকুপার বেশ কয়েকটা মাঠে দেখা গেল কৃষকরা তাদের খেতের রোপা আমনের মাঠে মাজরা ও অন্যান্য পোকার আক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করছেন স্প্রে মেশিন দিয়ে। গায়ের জামা ছাড়া মুখোশ, চশমা বা অন্য কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই এসব করছেন তারা। ঝিনাইদহের মনোহরপুর ও দামুকদিয়া মাঠে কথা হলো একাধিক কৃষকের সঙ্গে, যারা খেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন মেশিনের সাহায্যে।
মাঠে প্রচণ্ড গরম ও হালকা বাতাস উপেক্ষা করেই তারা ছিটিয়ে চলেছেন ‘ওষুধ’ বলে বিবেচিত কীটনাশক। কোনো প্রকার নিারাপত্তা বা সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই এমনভাবে কীটনাশক ছিটানোর কারণ জানতে চাইলে তারা সোজাসাপ্টা বললেন, সেই ছোটকাল খেকেই তো এভাবে ছিটাচ্ছেন, আজতক কোনো সমস্যা হয়নি। আর অতকিছু মানতে গেলে রাত-দিন বাবু (ভদ্রলোক) হয়েই বসে থাকতে হবে, মাঠের কাজ হবে না। অথচ, তারা অকপটে স্বীকার করলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা এসএএও এবং অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের বিষ বা কীটনাশক বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, মাঠদিবস ও অন্য অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন, শিশুসন্তান ও পরিবারের ভালোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বহুবার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ ব্যাপারে ডিএই-এর ঝিনাইদহ জেলা খামারবাড়ির উপ-পরিচালক ষষ্টিচন্দ্র রায়ের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল ধান, পাট, সবজি ও অন্য ফসলকে পোকার হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষকরা হরহামেশা রাসায়নিক কীটনাশক ছিটিয়ে থাকেন। অত দ্রুত ফল পাবার আশায় তারা এসব ছিটিয়ে থাকেন প্রয়োজনের তুলনায় বেশিবার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি কীটনাশকও ছিটিয়ে থাকেন বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ধানের চেয়ে সবজি, বিশেষ করে বেগুন, উচ্ছে বা করলা এবং অন্য সবজিতে যখন ইচ্ছে তখনই তারা মেশিনের সাহায্যে ছিটিয়ে দেন এই ‘ওষুধ’। ফলে ক্রমশ এসব ভায়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে বলে মন্তব্য করলেন উপ-পরিচালক ষষ্টিচন্দ্র রায়।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, অর্গানোফসফরাস, সাইফারমেথ্রিন প্লাস ক্লোরোফাইরিফস, ইমিডাক্লোরপ্রিড, কারটাপ, পাইরিথ্রোইড, লামডা-সাইহেলোথ্রিন, এবামেকটিন, মেলাথিয়ন, ডায়াজিনন, ডাইমেথোয়েড ও কার্বেফুুরানের মতো ভয়ানক বিষ তারা স্প্রে করে থাকেন অবলীলায়। স্প্রে করার সময় হাত-মুখ ঢেকে, চোখকে নিরাপদ রেখে এবং বাতাসের অনুকূলে থেকে তা স্প্রে করার কথা। কিন্তু কৃষকরা সাধারণত তা কখনো মানতে রাজি নন। তারা শুধু একটা ফুলহাতা সার্ট বা গেঞ্জি পরেই মাঠে চলে যান কীটনাশক ছিটাতে যেখানে মুখ, চোখ, নাক সবই থাকে অরক্ষিত।
কীটনাশকের প্রভাবে তাৎক্ষণিক শারীরিক সমস্যা ছাড়াও মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মন্তব্য করে ওই কৃষি কর্মকর্তা জানান, কাটনাশকের নিয়মবহির্ভূত ব্যবহারে মানুষের জেনেটিক সিনড্রোমের সমস্য ঘটাও বিচিত্র নয়। সেজন্য এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সুরক্ষার ব্যাপারটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ওই কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, এ বিষয়ে অধিকাংশ কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, মাঠদিবস বা অন্য দিবসের সভা ও সেমিনারে বলা হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ, তারা কোনো স্বাস্থ্যবিধিই মানতে নারাজ। তাদের কথা- ‘সবকিছুর মালিক ওপরওয়ালা’।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রাণী দেবনাথের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানালেন, এখনকার কৃষকদের অনেকেই ভালো লেখাপড়া জানেন। প্রতিটি বাড়িতেই শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বিদ্যমান অথচ, নিজেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তারা বেশ উদাসীন। কৃষকদের আরও সচেতন করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উঠানবেঠকের মতো অলোচনার ব্যবস্থাও করেছেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। তিনি এটাও জেনেছেন যে, মাঠপর্যায়ের এসএএও এবং অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন মাঠে গিয়ে প্রয়োজনে কৃষকদের সতর্ক করা হয়েছে। দেরিতে হলেও এক সময় কৃষকরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং সব নিয়মকানুন মেনে চলবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রাণী দেবনাথ।
আপনার মতামত লিখুন :