মিরপুর চিড়িয়াখানায় এসেছি বহুদিন পর। ভেতরে পা দিয়েই চোখে পড়ল প্রাণীদের ক্লান্ত চোখ আর জীর্ণ শরীর। এ যেন জীবন্ত এক কারাগার। প্রাণীগুলো এখানে বেঁচে আছে শুধু দম নিতে; তাদের মধ্যে আর কোনো প্রাণ নেই। বাঁধানো খাঁচায় বন্দি বাঘটি একবার হেঁটে ফিরে আসে আবার থেমে যায়। তার চলার মধ্যে কোনো শক্তি নেই, আছে শুধু এক অনিশ্চিত শূন্যতা। মানুষ দাঁড়িয়ে হাসছে, গল্প করছে, মোবাইলে ছবি তুলছে। কেউ খাঁচায় আঘাত করছে, কেউ অদ্ভুত আওয়াজ তুলে বাঘের মনোযোগ কাড়তে চাইছে। আর বাঘ? সে একবার তাকিয়ে আবার ফিরে যায় তার জগতে। অন্যদিকে বিশাল হাতিটি বিরাট খাঁচার কোণায় দাঁড়িয়ে আপন মনে ডাল-পাতা চিবাচ্ছে। তার চোখে বিষণ্নতা। চারপাশে মানুষ তাকে ঘিরে আছে, কেউ হাত উঁচিয়ে ডাকছে। হাতিটি কোনো সাড়া দেয় না। দেখে মনে হলো, তার অভিমান জমেছে পৃথিবীর প্রতি। কেউ তার শূন্য দৃষ্টিতে গভীরতা খুঁজছে না, শুধু তার শরীরের বিশালত্ব উপভোগ করছে। আমি ভাবতে লাগলাম, হাতিটি কতটা পরাজিত হলে এমন নিশ্চুপ থাকতে পারে।
পাশেই বাঁদরের খাঁচা। এখানে ভিড় একটু বেশি। খাঁচার বাইরে মানুষের হৈচৈ চলতেই থাকে। বাঁদরের খাঁচার সামনে একদল মানুষ দাঁড়িয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করছে। মানুষজন বাঁদরদের দিকে পাথর ছুড়ছে, কেউ কলা দেখিয়ে ঠাট্টা করছে, কেউ বা বাঁদরদের নকল করছে, তাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। বাঁদরও মানুষের সঙ্গে বাঁদরামি করছে। দাঁড়িয়ে ভাবলাম, মানুষের এই আচরণ আর বাঁদরের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু? মানুষ হয়তো খাঁচার বাইরে আছে বলে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান ভাবে। মনে হলো, চিড়িয়াখানার আসল চিরিয়া হয়তো মানুষই। যে প্রাণীগুলোকে দেখতে এসেছি, তাদের থেকে এই দর্শনার্থীরাই বরং বেশি বিনোদন দেয়।
কয়েকটি শিশু হরিণদের বিরক্ত করছিল। এক মা বলছিলেন, ‘এই ছেলেরা, শান্ত হয়ে দেখ, ঢিল ছড় না; বেচারা ভয় পাচ্ছে।’ শিশুরা শোনেনি। মনে হলো, এই শিশুগুলো বড় হওয়ার পর প্রাণীদের প্রতি কোনো মমত্ববোধ তৈরি হবে কি না। মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে কিছু কিছু বয়স্করাও যোগ দিচ্ছেন। ভাবলাম, আমরা নিজেদের সভ্য বলি, অথচ আমাদের আচরণে কত অসভ্যতার ছাপ। গেলাম পাখির খাঁচার দিকে। খাঁচার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, এই ছোট জায়গাটুকুতে রঙিন পাখিগুলো যেন তাদের ডানাগুলো মেলে ধরার সাহসই হারিয়ে ফেলেছে। এক সময় যারা মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াত, আজ তারা এই বন্দি অবস্থায় নিঃশব্দে কেবল বেঁচে আছে। ভাবলাম, এই পাখিগুলোও হয়তো অভিশাপ দিচ্ছে আমাদের, যারা তাদের আকাশ কেড়ে নিয়েছি।
শেষদিকে গেলাম কুমিরের পুকুরের পাশে। কয়েকটি কুমির স্থির হয়ে রোদ পোহাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হলো- যেন পৃথিবীর সবকিছু নিয়ে উদাসীন। আমার মনের গভীর থেকে প্রশ্ন উঠে এলো, ‘মানুষের কি কখনো এই ধরনের শান্তি পাওয়া সম্ভব?’ কুমিরটি হয়তো আমার মনের কথা শুনতে পেল। মনে হলো, সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে, ‘তোমরা মানুষ! কেন আমাদের বন্দি করে রেখেছ? বাইরে কি জায়গার এত অভাব?’ মনে মনে বললাম, ‘আমরা মানুষ; বড়ই বিচিত্র। নিজেদের আনন্দের জন্য অন্যদের বেদনা বোঝার সময় কোথায়?’
চিড়িয়াখানার প্রতিটি জায়গায় এ রকম ভগ্ন প্রাণীদের কাহিনি। তাদের শরীর বলে দিচ্ছে, তারা কেবল বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে আছে। আর দর্শনার্থীরা? তারা প্রাণীদের দেখে আনন্দিত, ঠাট্টা-মশকরা করছে। আমাদের অমানবিকতা, নির্বোধ আচরণ আর বিবেকহীন বিনোদনের জন্য প্রাণীদের এখানে বন্দি করা হয়েছে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হলো, সুস্থ মানুষের আসলে চিড়িয়াখানায় প্রাণী দেখতে নয়, মানুষ দেখতে যাওয়া উচিত। কারণ মানুষের আচরণই এখানে সবচেয়ে বেশি চিরিয়া প্রকৃতির। পৃথিবীকে নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কত সংকীর্ণ। আমরা যে কত অসভ্য, তা নিজেরা জানিই না। চিড়িয়াখানায় বন্দি এই প্রাণীগুলো আমাদের প্রতি চুপচাপ একটাই বার্তা দেয়, মানুষ হও...
আপনার মতামত লিখুন :