ঢাকা রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মোটরসাইকেল বলতে আমরা যা বুঝি

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম

মোটরসাইকেল বলতে আমরা যা বুঝি

ছবি: ইন্টারনেট

বাংলাদেশে বড় হয়ে থাকলে কখনো না কখনো অবশ্যই খেয়াল করেছেন, সব ধরনের মোটরসাইকেলকেই মানুষ ‘হোন্ডা’ নামে ডাকে। কখনো কি এর পেছনের কারণ জানতে ইচ্ছে হয়েছে? তবে চলুন জানা যাক—


অনেকেরই ধারণা, হোন্ডাই বাংলাদেশের প্রথম মোটরসাইকেল ছিল এবং একসময় দেশে শুধু হোন্ডা মোটরসাইকেলই পাওয়া যেত; তাই হয়ত এই নামটা এত প্রচলিত।কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়।সত্য হলো,এটি মূলত হোন্ডা র্ব্যান্ডের জনপ্রিয়তার ফলাফল। ১৯৮০-এর দশকে হোন্ডা বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে, এবং এরই ফলস্বরূপ হোন্ডা র্ব্যান্ডটি দেশজুড়ে এতটাই পরিচিত হয়ে ওঠে যে, অন্য র্ব্যান্ডের মোটরসাইকেলকেও মানুষ "হোন্ডা" নামে ডাকতে শুরু করে, এবং এই প্রবণতা এখনো চলছে। হোন্ডা এই দেশের প্রথম মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড না হলেও, এর ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ।

হোন্ডা মোটর কোম্পানি লিমিটেড, ১৯৪৬ সালে জাপানের টোকিওতে সোইচিরো হোন্ডা এবং তাকেও ফুজিসাওয়ার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানিটি প্রথমে ছোট ইঞ্জিন এবং বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরি করা দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে তারা মোটরসাইকেল ও গাড়ি উৎপাদনে নিজেদের দক্ষতা দেখাতে শুরু করে। ১৯৫৯ সালের দিকে হোন্ডা বিশ্বের সর্ববৃহৎ মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাশ্রয়ী, টেকসই এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন ও যানবাহন উৎপাদন করা।
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে, হোন্ডা গাড়ি নির্মাণেও বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং পরিবেশ বান্ধব যানবাহন তৈরির ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা তাদেরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। হোন্ডা এমন একটি র্ব্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যা ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশে হোন্ডার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে, তখন প্রথমবারের মতো এ দেশে হোন্ডার মোটরসাইকেল আমদানি করা হয়। ২০১২ সালে, বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড (ইঐখ) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা হোন্ডার মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য একটি যৌথ উদ্যোগ ছিল। ২০১৮ সালে, হোন্ডা কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের প্রথম মোটরসাইকেল উৎপাদন কারখানা স্থাপন  করে। বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড দাপটের সাথে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।  বিএইচএলের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা শাহ মুহাম্মদ আশেকুর রহমান বলেন, ‘একমাত্র হোন্ডাই বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের পুরো ইঞ্জিন তৈরি করছে। হোন্ডা এক্স ব্লেড মডেলের সব অংশই বাংলাদেশে তৈরি। হোন্ডার মোটরসাইকেলগুলো জাপানের কারিগরি বিশেষজ্ঞেরা যাচাই করেন।’ দেশের মোটরবাইক বাজারের একটি বড় অংশ এই কোম্পানির দখলে রয়েছে, যা দেশের বাজারে মোটরসাইকেলের চাহিদা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
হোন্ডা মোটরসাইকেলের একটি বড় ইতিবাচক দিক হলো এর টেকসইতা। হোন্ডার বাইকগুলো দীর্ঘস্থায়ী এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়, যা ব্যবহারকারীদের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক। হোন্ডার ইঞ্জিনগুলো খুবই সাশ্রয়ী এবং জ্বালানি দক্ষ, যা বর্তমান সময়ে পরিবেশবান্ধব যানবাহনের প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হোন্ডা তাদের মোটরসাইকেলের ডিজাইনেও অত্যন্ত মনোযোগী, যেখানে নিরাপত্তা ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত রয়েছে। এছাড়াও, হোন্ডার মোটরসাইকেলের রিজেল ভ্যালু বেশ ভালো, যা ক্রেতাদের বিনিয়োগের জন্য একটি সাশ্রয়ী সমাধান ।
হোন্ডা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বেশ আগ্রহী, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনের ক্ষেত্রে। পরিবেশ দূষণ কমাতে এবং নতুন প্রজন্মের চাহিদা পূরণে, হোন্ডা ইতোমধ্যেই বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল ও হাইব্রিড প্রযুক্তির উপর কাজ করছে। এমনকি বাংলাদেশেও হোন্ডা তাদের বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল আনতে পরিকল্পনা করছে, যা ভবিষ্যতে পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাবে। বিএইচএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শিগেরু মাতসুজাকি বলেন ‘এ বছরেই বাংলাদেশে হোন্ডার বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) তৈরির কাজ শুরু হবে।’ বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন বাড়াতে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে ডিউটি ফ্রি সুবিধাও দাবি করেন তিনি। এছাড়াও, স্মার্ট প্রযুক্তি ও সেফটি ফিচার যুক্ত মোটরসাইকেল তৈরি করাও তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার।
বর্তমান অবস্থার কথা উল্লেখ করে শিগেরু মাতসুজাকি বলেন, ‘হোন্ডা বাংলাদেশ মোটরসাইকেল উৎপাদন করে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে; কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় মোটরসাইকেল তৈরিতে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এই সংকট কাটিয়ে আমরা স্থানীয় সরবরাহ বৃদ্ধি ও রপ্তানি শুরুর মধ্যমে ডলারুসংকট দূর করতে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছি।’
বিশ্বব্যাপী মোটরসাইকেল শিল্পের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে হোন্ডা সবসময় উদ্ভাবনের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে যানজট এবং জ্বালানির সমস্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, সেখানে হোন্ডার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো সময়ের চাহিদার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।আশা করা যায়, হোন্ডা মোটর কোম্পানি লিমিটেড এভাবেই তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখবে যাতে করে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মরাও পূর্ববর্তীদের মতো সব ধরনের মোটরসাইকেলকে হোন্ডা নামে ডাকবে।

আরবি/ আরএফ

Link copied!