ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

ভালো স্পর্শ এবং মন্দ স্পর্শ

তানিয়া হাসান

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২৪, ১২:৫৮ পিএম

ভালো স্পর্শ এবং মন্দ স্পর্শ

ছবি: সংগৃহীত

আপনারা নিশ্চয় জানেন ভাষা  শেখার আগেই শিশু তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিনতে শেখে যেমন- আমরা বলি, ‘দেখাও তো তোমার নাক কোনটি?’ শিশু কিন্তু নির্ভুলভাবে তা শনাক্ত করতে পারে। শিশুকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে পরিচিত করার সবচেয়ে সঠিক সময় হচ্ছে একেবারে যখন সে একটু একটু কথা বলতে শিখছে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন তা অনেক মা-বাবাই বুঝে উঠতে পারেন না। এজন্য এই সময়গুলো খুব কার্যকর;

* ন্যাপি বদলানোর সময় 
* শিশুকে গোসল করানোর সময় 
* কাপড় বদলে দেওয়ার সময় 
* পটি করার সময় এবং টয়লেট ট্রেনিং দেওয়ার সময় 
* শিশু যখন পুতুল, খেলনা এবং বাড়ির পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলে 
* যখন শিশু আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে 
* যখন আপনাকে কাপড় বদলাতে দেখে 
* যখন আপনি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্রম সম্পর্কে ওকে শিক্ষা দেন

শিশুর জন্য পুতুল কেনার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন। ভালো করে যাচাই করে দেখুন, পুতুলটির গড়ন অবিকল মানুষের মতোই কিনা? এতে আপনার সহজ হবে ওকে বোঝাতে। শিশুকে অন্য কোনো প্রতীকী নামে শরীরের অঙ্গের নাম শেখাবেন না। যদি কখনো শিশু খেলা করতে গিয়ে ব্যথা পায় বা কেউ তাকে আঘাত দেয় তাহলে; যখন চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবেন, চিকিৎসকের বুঝতে অসুবিধা হবে আসলে ওর কোথায় কষ্ট হচ্ছে বা কোন অঙ্গের চিকিৎসা করতে হবে। ঈশ্বর না করুন, যদি শিশু কারো মাধ্যমে নির্যাতিত হয় এবং আইনের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হয়, তাহলেও বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতে শিশুর পক্ষে কঠিন হবে, যে ঠিক কী ঘটছে ওর সঙ্গে।  

শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত দেশের অভিভাবকরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না শিশুর সঙ্গে গোপন অঙ্গের বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে। শুধু তাই নয়; আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক, আমাদের জন্যও কি এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা খুব সহজ? বেশিরভাগ সময় আমরা সচেতনভাবে এই বিষয়টা এড়িয়ে চলি। তবে আমরা যতই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে ইতস্ততবোধ করি না কেন, আমাদের সন্তানেরা কিন্তু একসময় ঠিকই জেনে যায় এই গোপন বিষয়গুলো। বন্ধু, আত্মীয় বা মুভি কিবা টিভি দেখে ভুলভাল তথ্য না শেখে। তার চাইতে তাদের সঠিক শিক্ষা হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রায় সব পরিবারেরই অলিখিত কিছু নিয়ম থাকে যা পরিবারের সবাই মেনে চলে। যদি আপনি আপনার শিশুদের সচেতনভাবে সতর্ক করে দেন যে, তারা তাদের গোপন অঙ্গের বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না। তাহলে তারা শিশুকাল থেকে এমন ধারণা পোষণ করবে। এসব অত্যন্ত লজ্জাজনক কোনো বিষয়। আপনাদের এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে তারা কখনোই সহজবোধ করবে না। নিজেদের শারীরিক কোনো সমস্যা হলে আপনাদের খুলে বলতে পারবেন না, কেউ যদি তাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে তাহলেও তারা সেটা গোপন করে রাখবে।

তাই কতগুলো বিশেষ সতর্কতা মেনে চলুন। শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সম্পর্কে ওকে শুধু বুঝিয়ে বলাটাই যথেষ্ট নয়। ওকে শেখান কেউ যদি ওর শরীরকে (সেটা যে অংশই হোক) স্পর্শ করে আর তা যদি ওর কাছে ভালো না লাগে তা যেন, আপনাকে জানায় আর সে মানুষ যেই হোক এমন কী নিজের বাবাও যদি হয়। শিশু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুধু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা যেমন জরুরি। একই সঙ্গে তাকে শেখানো প্রয়োজন অন্যেরা যেমন তার গোপন অঙ্গকে স্পর্শ করতে পারবে না তেমন সে নিজেও এমন কাজ করবে না কোনো মতেই।

আপনার শিশুর যেন আপনার প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস থাকে যেকোনো সমস্যা নিয়ে ওরা আপনার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবে। প্রশ্ন যতই অস্বস্তিকর হোক আপনার জন্য, আপনি যদি আগে থেকে তার মোকাবেলার করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখেন তাহলে এর উত্তর দেয়াটা আপনার জন্য অতটা কঠিন হবে না। তবে শিশুকে শেখানোর সব চাইতে উত্তম উপায় হচ্ছে, ওদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া এবং শেখানো প্রয়োজন শরীর এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ ওদের ব্যক্তিগত বিষয়। অন্য কোনো মানুষের এসবের প্রতি কৌতূহল দেখানো, দেখা এবং স্পর্শ করার অধিকার কারো নেই। শুধুমাত্র মা-বাবা এবং ডাক্তার ব্যতীত।    

আপনারা যারা, বিশেষ করে যেসব মা-বাবারা এই লেখাটি পড়ছেন। তাদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ রইল, আপনার শিশু বলা এবং না বলা কথা দয়া করে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। হোক তা যত তুচ্ছ। অনেক শিশু নানা ধরনের কল্প কথা বলতে ভালবাসে। কিন্তু, মনে রাখবেন যৌন নিপীড়ন হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা সম্পর্কে ছোট শিশুদের কোনোরকম ধারণা থাকে না যে, তারা বানিয়ে গল্প বলবে। পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ককে বাঁচাতে গিয়ে, আপনার শিশুকে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দেবেন না। তাই বিশেষভাবে কতগুলো বিষয়ে সতর্ক হোন, লক্ষ্য করুন যে আপনার শিশুটি হঠাৎ করে কোনোরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছে কি-না, যেমন;

* অকারণেই চমকে ওঠা, 
* বেশি বয়সে রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, 
* একা থাকার প্রবণতা,
* কথা কম বলা,
* খেতে না চাওয়া অথবা অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, 
* বিষণ্ন হয়ে যাওয়া
* বাড়িতে বিশেষ কোনো অতিথি এলে তার সামনে না যেতে চাওয়া, যদিও আগে এই ব্যক্তিটি এলে ও খুশি হতো 
* কেউ জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইলে বিরক্ত হওয়া অথবা ছটফট করা, বা ছুটে পালিয়ে যাওয়া

যদিও এতে অনেক সময় আমরা অপ্রস্তুত হই লজ্জিত হই যে, আমার সন্তানটি দিনে দিনে অসামাজিক হয়ে পড়ছে। দয়া করে ওকে বাধ্য করবেন না এমন আত্মীয় বা পরিচিতজনের সান্নিধ্যে আসতে। ওকে একান্তে জিজ্ঞেস করুন এমন আচরণের কারণ। দুঃখজনক হলে সত্যি যে, অনেক মা-বাবারা নিজের সন্তানদের কথা বিশ্বাস করেন না অথবা পারিবারিক এবং সামাজিক নিন্দার ভয়ে গোপন করে যান এবং তাদের সন্তানদেরও বলেন কাউকে না জানাতে এবং ভুলে যেতে। এমন কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা যদি কোনো শিশুর সঙ্গে ঘটে সেটা সারা জীবনের জন্য তার মনের ভেতরে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে, কোনো কোনো শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরও এসব কষ্টদায়ক স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে পারে না, মানসিক বিষাদের শিকার হয়। মানুষের প্রতি অবিশ্বাস জন্মায়, কারো সঙ্গে রোম্যান্টিক সম্পর্ক গড়তেও  ভয় পায়। কোনো কোনো শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজে অন্য শিশুদের যৌন নির্যাতন করতে আনন্দ পায়।

শিশু নিজ গৃহে কতটা সুরক্ষিত? 
আমাদের অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই যে, কতভাবে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হতে পারে। এমনকী নিজের বাড়িতেও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। শুধু মেয়ে শিশুই নয়, ছেলে শিশুদের যৌন হয়রানির হার মেয়েদের চাইতে খুব একটা কম নয়। 
আপনার শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তাকে অভয় দিন আপনারা ওর পাশে আছেন, প্রয়োজনে মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

লেখক: কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট 
তথ্যসূত্র : মনকাহন (২য় খণ্ড) পাওয়ার অফ পজিটিভ প্যারেন্টিং

আরবি/ আরএফ

Link copied!