সকালে মনে হলো শহরের কোলাহলটা একটু উপভোগ করতে হবে। তাই লোকালবাসে চড়ে একটু ঘোরার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকার লোকালবাস; যেখানে জীবনের নানা রঙ ছড়িয়ে থাকে। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলাম, প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করছে। কন্ডাক্টর চিৎকার করে ফার্মগেট, শাহবাগ, গুলিস্থান বলে চিল্লাচিল্লি করছে। বাস এলো, কিন্তু সেটাতে ওঠা একপ্রকার যুদ্ধ। ধাক্কাধাক্কি করে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। বসার জায়গা নেই। সিটগুলো আগেই ভরে গেছে।
বাসের ভেতরে এক অন্যরকম পরিবেশ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোর বারবার ড্রাইভারকে থামার জন্য বলছে। কন্ডাক্টর বিরক্ত মুখে বলল, ‘এতহানে থামলে অইবো না, একটু খাড়ান?’ অন্যদিকে, জানালার পাশে বসা এক বৃদ্ধা আপন মনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে অদ্ভুত এক ক্লান্তি। আশপাশে শ্রমিক, শিক্ষার্থী, অফিসগামী; আমি জানি, সবারই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প।
আমি পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে আছি। পাশে এক অল্পবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটা মোবাইল, কানে ইয়ারফোন। চোখে যেন নতুন জীবনের স্বপ্ন। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন কুদ্দুস সাহেব; বন্ধু শফিকের কলিগ; পকেট থেকে একখানা রুমাল বের করে ঘাম মুছছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘এই বাসযাত্রা, বুঝলেন! জীবনের মতোই। কেউ বসার জায়গা পায়, কেউ শুধু দাঁড়িয়েই যাত্রা শেষ করে।’
তার কথার গভীরতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল। আমরা কি সবাই আসলে একই বাসের যাত্রী নই? কেউ একটু আরাম পায়, কেউ স্রেফ টিকে থাকার লড়াইয়ে থাকে। এই ভাবনার মধ্যেই বাস একটা ছোট্ট বাজারে থামল। লোকজন নামছে, উঠছে। আশপাশে মাটির হাঁড়ি, ফলের ঝুড়ি নিয়ে বিক্রেতারা বসে আছে। কিছুক্ষণ পর বাস আবার চলতে শুরু করল।
কুদ্দুস সাহেবের সঙ্গে গল্প শুরু হলো। তার কাছে জানতে পারলাম শফিকের চাকরিটা আর নেই। পাগলটার সঙ্গে দেখা করতে হবে একদিন। কুদ্দুস সাহেব গ্রামের মানুষ, শহরে এসেছিলেন একজন আত্মীয়ের খোঁজে। বললেন, ‘গ্রামে জীবন সরল, কিন্তু কষ্ট কম নয়। শহরে এসে দেখি, মানুষ আরও অস্থির। সবাই দৌড়াচ্ছে, কিন্তু কিসের জন্য দৌড়াচ্ছে, তা যেন কেউ জানে না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে আপনার কাছে সুখ মানে কী?’
তিনি একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘সুখ মানে হলো নিজের প্রয়োজন বোঝা। বেশি চাইলে কষ্ট বাড়ে। কম চাইলে জীবনটা সহজ হয়। আমরা কেউই সবকিছু পাব না। তাই যা আছে, সেটার মধ্যেই তৃপ্ত থাকা শিখতে হবে।’
কঠিন সময়ে সহজ মানুষও দার্শনিক হয়ে যায়। আমি বুঝলাম কুদ্দুস সাহেব জীবনের কঠিন সময় পার করছেন।
বাস ধীরে ধীরে গ্রামের পথ ধরল। চারপাশে ধানক্ষেত, ছোট টিনের ঘর, আর দূরে দেখা যায় একটা বাঁশের সাঁকো। কুদ্দুস সাহেব জানালা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে গ্রাম, এই প্রকৃতি; এটাই আসল। শহরের বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু গ্রামে বাঁচার জন্য বেশি কিছু লাগে না।’
বাস আবার একটা স্টপেজে থামল। এবার কুদ্দুস সাহেব নেমে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ‘ভাই, জীবনের গল্প শেষ হয় না। এই যাত্রাটা কেবল শুরু।’ মনে হলো কুদ্দুস সাহেব যেনো আমার ক্যারেক্টারে অভিনয় করে গেলেন।
বাস চলতে শুরু করল, আর আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে তার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। জীবনও কি তবে এমন লোকালবাস? প্রতিটি ধাক্কা, প্রতিটি বিরতি- সবই এক একটা গল্প।
আপনার মতামত লিখুন :