স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম, রুচিশীল এবং ঐতিহ্যবাহী অমর একুশে গ্রন্থ মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে আয়োজন হয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং পাঠকের বৃহত্তম মিলন উৎসব। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। মেলার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নবীন-প্রবীণ লেখকদের সাবলীল এবং সৃজনশীল ভাবনা বিকাশে অনবরত কাজ করে করে যাচ্ছেন প্রকাশকরা। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিভিন্ন দুর্যোগ দুর্বিপাকে কেমন চলছে বইমেলার প্রস্তুতি? এই নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রবীণ এবং নবীন প্রকাশদের। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
মাজহারুল ইসলাম (অন্য প্রকাশ)
‘অন্যপ্রকাশ’ বছরভরই বই প্রকাশ করে থাকে। তবে এ কথা ঠিক, অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয় একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। মেলাকেন্দ্রিক এ বইগুলোর প্রাথমিক কাজ অর্থাৎ পাণ্ডুলিপি নির্বাচন চলে জুন-জুলাই-আগস্টে। অন্য বছরগুলোর বিবেচনায় এ বছর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। তবে আমরা কাজ শুরু করেছি এবং প্রক্রিয়াটি চলমান। তাই আসন্ন মেলায় কী কী বিশেষ বই থাকছে, সেটা জানার জন্য আরেকটু অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে পাঠকদের জানাতে চাই, বরাবরের মতোই এবারও রুচিশীল পাঠকেরা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও নান্দনিক প্রকাশশৈলীর বই পাবেন ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে। ‘অন্যপ্রকাশ’ প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদেরও বই প্রকাশ করে আসছে প্রতিবছর। নবীন লেখকদের বই প্রকাশে বিষয় এবং পাণ্ডুলিপির গুণগত মান নিশ্চিত হই আমরা। আমাদের একটি নির্বাচক প্যানেল এই কাজটি করেন।
অচিন্ত্য চয়ন (দেশ পাবলিকেশন্স)
আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। প্রকাশনা নিয়ে আমার বড় স্বপ্ন আছে। সময় যতই খারাপ যাক না কেন, আমি ইতিবাচকভাবেই ভাবছি। গত বছরের তুলনায় এবার বইমেলা ভালো হবে। ইতোমধ্যেই বইমেলার প্রস্তুতি চলছে। এবারের মেলায় নির্বাচিত কিছু বই আসবে, যা পাঠকের জন্য জরুরি। এ ছাড়া ‘দেশ পাবলিকেশন্স’ থেকে এবারের মেলা উপলক্ষে বিশেষ কিছু অনুবাদেরও কাজ করছি। আশা করি পাঠকের জন্য নতুন কিছুই হবে। ‘দেশ পাবলিকেশন্স’ সবসময় তরুণদের একটি ভরসার জায়গা। আমরা তরুণদের নিয়ে কাজ করি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। পাঠকের কাছে অনুরোধ বই পড়ে মতামত জানাবেন তবেই তরুণরা উৎসাহ পাবেন। সর্বোপরি পাঠ্যভ্যাসটা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
আদিত্য অন্তর (ইত্যাদি প্রকাশন)
ইত্যাদি প্রকাশন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সব সময়য়ই নবীনদের প্রাধান্য দিয়ে আসছে। প্রতিছরের ন্যায় এ বছরও নবীনদের বেশ কিছু বই ইত্যাদি প্রকাশন থেক প্রকাশিত হবে। আমাদের প্রকাশনী থেকে গত বইমেলায় হাসান আজিজুল হকের রচনাবলি বেশ সাড়া ফেলেছিল। তাই আমদের পরিকল্পনা ছিল এ বছর সেলিনা হোসেন রচনাবলি নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা সম্ভব হবে তা বলতে পারছি না। এ ছাড়া আরেকটা কথা ক্লিয়ার করা দরকার, বইমেলা আসলেই কাগজ, কালি এবং বইয়ের প্লেটের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কোনো কমিটি কিংবা সংগঠন করে এ বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আর স্টল ভাড়ার ক্ষেত্রেও নজর দেওয়া জরুরি।
অঞ্জন হাসান পবন (কিংবদন্তী পাবলিকেশন)
কিংবদন্তী পাবলিকেশন সবসময় মানসম্মত লেখা নিয়ে কাজ করে। এবারের বই মেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না। এ ছাড়া মানসম্মত পাণ্ডুলিপি নিয়ে কিংবদন্তী পাবলিকেশনের সহযোগী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দূরবীণ থেকে বেশকিছু নতুন লেখকের বই প্রকাশ হচ্ছে। তবে একটা দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে- প্রতিবছর বইমেলার আগে কাগজের দাম বেড়ে যায়। পুরো সিস্টেমটা সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। এখানে করার আছে অনেক কিছুই কিন্তু বাস্তবায়ন নেই, জবাবদিহিতা নেই। যে যেভাবে পারছে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও এটা এখন সয়ে গেছে, তারপরও এর যথার্থ সমাধান নিশ্চিত করার অনুরোধ রাখছি। সবকিছু ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ছাপার কাজ শুরু হবে পহেলা জানুয়ারি ২০২৫ থেকে। বাংলা একাডেমির কাছে প্রত্যাশা সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে বইমেলার আয়োজন হোক। স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতা দরকার। স্টল ভাড়া কমানোর দাবিটা যৌক্তিক। বিষয়গুলো নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে বাংলা একাডেমির।
জাকির হোসাইন (ভূমি প্রকাশ)
বেশ কয়েক বছর করোনা মহামারি কিংবা রাজনৈতিক কারণে মেলা ভালো না হওয়ায় কিছুটা ঢিমেতালে কাজ চলছে। নভেম্বর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করব। প্রস্তুতি বললে বলতে হবে, মোটামুটি। ভূমি প্রকাশ সবসময় নিয়মিত নবীন কিন্তু প্রমিনেন্ট রাইটারদের নিয়ে কাজ করে। বইমেলার আকর্ষণ যেহেতু বই সেহেতু আমরা সবসময় ভালো বই নিয়েই কাজ করি। তাই বলা চলে ভূমির প্রতিটা বই-ই বিশেষ আকর্ষণ। আমাদের কয়েকজন লেখক বিভিন্ন ব্যস্ততার জন্য মাঝে লিখতে পারেননি। এবার উনাদের অনেকেই লেখালেখিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা বিশেষ কিছু হবে আশা করি। এ ছাড়াও দেশের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তনও একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছি। যারা বই পড়েন, তাদেরকে বলব আপনারা ভালো বইগুলো পড়ুন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করুন। সঙ্গে বছরে অন্তত ১টা বই নবীন লেখকদের বই পড়ুন। তাদের উৎসাহ দিন।
তানভীর আহমেদ (উপকথা প্রকাশন)
আমাদের ছাপা সারা বছরই হয়। উপকথা প্রকাশন থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নতুন বই আসে বা রিপ্রিন্ট হয়। তরুণ আর প্রবীণ লেখক ম্যাটার করে না। ম্যাটার করে মেধা। লেখা মানসম্মত না হলে প্রবীণ লেখকদেরও সুযোগ নেই। কাগজের দাম সারা বছরজুড়েই বাড়তি। হাসিনার আমলে হুট করে ১৫০০ টাকার কাগজ ৩৩০০ টাকা হয়ে গেল যা এখনো কমেনি। এ সরকারের কাছে আমরা ভালো কিছুর আশা রাখি। বাংলা একাডেমির কাছে এবার প্রত্যাশা অনেক বেশি। ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে বড় দাবি হলো- এবার যেন প্যাভিলিয়ন না থাকে। এটা বড় বৈষম্য। সরকারের কাছে ভালো কিছু আশা করি। বই পড়ার একটা রেভ্যুলেশন হবে এদেশে এই স্বপ্নই আমি দেখি।
আপনার মতামত লিখুন :