সমুদ্রের বুকে বিস্তৃত এক অদৃশ্য জাল, মানুষসহ যেখানে মিলিয়ে যায় জাহাজ, হারিয়ে যায় আকাশে উড়ন্ত পাখির মতো বিমান। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই, শুধু রহস্যময় নিস্তব্ধতা। এমনই এক রহস্যময় স্থানের নাম বারমুডা ট্রায়াংগেল। পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত এই স্থানটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি অঞ্চল, যার অবস্থান বারমুডা, ফ্লোরিডার মায়ামি এবং পুয়ের্তো রিকোর মধ্যবর্তী এলাকাজুড়ে। প্রায় ৫ লাখ বর্গমাইল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে বহু বছর ধরে মানুষ ভাবছে, লিখছে, এবং গবেষণা করছে। তবে সত্যিকার অর্থে, বারমুডা ট্রায়াংগেলের রহস্য আজও সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়নি। বরঞ্চ এই স্থানকে ঘিরে তৈরি হওয়া গল্প, সাহিত্য, আর বিজ্ঞানের মধ্যকার এই দোদুল্যমান অবস্থা একে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
বারমুডা ট্রায়াংগেলের রহস্য নিয়ে আলোচনা মূলত শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রে এই স্থানের নাম উঠে আসে বেশ কয়েকটি জাহাজ ও বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পর। ১৯৬৪ সালে, ভিনসেন্ট গ্যাডিস তার প্রবন্ধে ‘দ্য ডেডলি বারমুডা ট্রায়াংগেল’ নামক একটি টার্ম ব্যবহার করেন। এই নামকরণ থেকেই মূলত এই অঞ্চলটি মানুষের মনে এক বিশেষ রহস্যের জন্ম দেয়। যদিও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত নয়, তবু এ ধরনের গল্প মানুষের কৌতূহলকে বাড়িয়ে দেয়।
সাহিত্যে বারমুডা ট্রায়াংগেলের ব্যাপক চর্চা হয়েছে। সাহিত্য বরাবরই কল্পনার বিশাল একটি জায়গা। নানান সময়ে লেখকরা তাদের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করে বারমুডা ট্রায়াংগেলের ওপর ভিত্তি করে অনেক জনপ্রিয় বই ও সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে বারমুডা ট্রায়াংগেলকে ভিনগ্রহের প্রাণী বা সময়ের ভিন্নমাত্রা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এ রকম কল্পকাহিনীগুলোতে দেখা যায়, যেসব জাহাজ বা বিমান নিখোঁজ হয়েছে, তারা আসলে অন্য কোনো সময় বা স্থানে চলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, চার্লস বার্লিটজের বিখ্যাত বই ‘দ্য বারমুডা ট্রায়াংগেল’ এ ট্রায়াংগেলকে এক ভিনগ্রহীয় শক্তির অধিকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তার মতে, এই অঞ্চলকে ঘিরে যেসব নিখোঁজের ঘটনা ঘটে, সেগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটছে না, বরং এর পেছনে অন্য কোনো অলৌকিক শক্তি কাজ করছে। একইভাবে, রিচার্ড উইনারের লেখা ‘দ্য ডেভিলস ট্রায়াংগেল’ বইটিতে বলা হয়েছে, বারমুডা ট্রায়াংগেল শুধুমাত্র নিখোঁজের ঘটনা বা অস্বাভাবিক অবস্থান নয়, বরং এটি এক ধরনের ‘দুর্ভাগ্যের ত্রিভুজ’, যেখানে সাধারণ পদার্থবিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করে না। তিনি বিভিন্ন নিখোঁজ ঘটনা, যেমন বিমানের অদৃশ্য হওয়া বা জাহাজের কোনো চিহ্ন না রেখে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে এই সব রহস্যময় ঘটনা কোনো না কোনো অলৌকিক শক্তি বা অজানা প্রাকৃতিক কারণে ঘটছে। উইনার বিশ্বাস করেন যে, এই অঞ্চলটি এমন এক জায়গা যেখানে সময় এবং স্থানের সাধারণ নিয়মগুলো বাধাগ্রস্ত হয়, এবং এটি সম্ভাব্যভাবে এক ধরনের টাইম পোর্টাল বা অন্য মাত্রায় যাওয়ার পথ হতে পারে।
এমন ব্যাখ্যাগুলো সাহিত্যে বারমুডা ট্রায়াংগেলকে এক রহস্যময় স্থানের পাশাপাশি সময় ভ্রমণ, ভিনগ্রহের যোগাযোগ এবং অলৌকিক ঘটনার কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরেছে।
তবে সাহিত্য যেখানে বারমুডা ট্রায়াংগেলের ঘটনাগুলোকে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতভাবে চিত্রিত করে, বিজ্ঞান সেখানে সবকিছুর যৌক্তিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে। সেই ধারা বজায় রেখে বারমুডা ট্রায়াংগেলের নিখোঁজের ঘটনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেছেন।
একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বারমুডা ট্রায়াংগেলের অঞ্চলে চৌম্বকীয় বিপর্যয় ঘটে থাকে, যা কম্পাস এবং অন্যান্য নেভিগেশন যন্ত্রকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ফলে, জাহাজ ও বিমানের দিকভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা আরও একটি প্রাকৃতিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, সেটি হলো মিথেন গ্যাসের বুদবুদ। সমুদ্রের তলদেশে মিথেন গ্যাসের বিশাল বুদবুদ তৈরি হতে পারে, যা পানির ঘনত্ব কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে জাহাজ ডুবে যেতে পারে।
আবহাওয়ার ক্ষেত্রেও বারমুডা ট্রায়াংগেল একটি চ্যালেঞ্জিং জায়গা। এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ো বাতাস, এবং বজ্রপাত অনেক বেশি সক্রিয় থাকে, যা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পেছনে দায়ী হতে পারে। অনেক গবেষক মনে করেন, এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগই বারমুডা ট্রায়াংগেলের রহস্যময় নিখোঁজের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
সাহিত্য আর বিজ্ঞান, দুটিই বারমুডা ট্রায়াংগেলের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। সাহিত্যে বারমুডা ট্রায়াংগেলকে এক অলৌকিক বা রহস্যময় স্থান হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যেখানে প্রতিটি ঘটনা অস্বাভাবিক এবং এর পেছনে রয়েছে কোনো অপরিচিত শক্তি। এই ব্যাখ্যাগুলো মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে, পৃথিবীর কিছু রহস্য হয়তো কোনোদিনই বিজ্ঞান দ্বারা উন্মোচিত হবে না।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান সবকিছুকে প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে রাখতে চায়। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় বারমুডা ট্রায়াংগেলকে আর দশটি সমুদ্র এলাকার মতোই দেখা হয়, যেখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের মতে, সেখানে এমন কোনো অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কিছু নেই যা ব্যাখ্যার অতীত।
আপনার মতামত লিখুন :