ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ঘরে বসেই অল্প পুঁজির ব্যবসা

খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ০৪:১২ পিএম

ঘরে বসেই অল্প পুঁজির ব্যবসা

ছবি: সংগৃহীত

আগুন জ্বালালে তা ধীরে ধীরে পুড়ে চারপাশে সুগন্ধ ছড়ায়। সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানে আগরবাতি জ্বালানো হয়। আগরবাতি জ্বালালে ঘরের পরিবেশ ও চারপাশ সুগন্ধে ভরে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসা হিসেবে আগরবাতি তৈরি করে আয় করা সম্ভব। যেকোনো ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য আগরবাতি তৈরির ব্যবসা শুরু করতে পারেন। আগরবাতির চাহিদা প্রায় সারা বছরই থাকে। মন্দির, মসজিদ, গির্জা প্রভৃতি উপাসনালয়ে বা বাড়িতে পূজা বা মিলাদে আগরবাতি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সুগন্ধি হিসেবে এখন অনেকে প্রতিদিন ঘরে বা দোকানেও আগরবাতি ব্যবহার করেন। স্থানীয় বাজার, থানা শহর অথবা উপজেলা শহরে আগরবাতি বিক্রি করা যায়। পাইকারি হিসেবে দোকানদারদের কাছে অথবা খোলা বাজারে বা হাটে খুচরাভাবে ক্রেতাদের কাছে আগরবাতি বিক্রি করা সম্ভব। সবচেয়ে বেশি বিক্রি করা যায় মাজারের কাছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপাসনালয়ে আগরবাতি বিক্রি করা সম্ভব।

আগরবাতি তৈরির জন্য স্থায়ী উপকরণ কিনতে আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ টাকার প্রয়োজন হবে। ১০০টি আগরবাতি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনতে আনুমানিক ৩ হাজার টাকার প্রয়োজন হবে। অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে আগরবাতি তৈরি এবং এ ব্যবসার বিস্তারিত জেনে নিলে ব্যবসা করতে সুবিধা হবে।

আগরবাতি তৈরি করতে যা যা লাগবে

স্থায়ী উপকরণ
গামলা, বাটি, ডালা, চুলা, পিঁড়ি ও বেলন, দাড়িপাল্লা, চালনি, প্যাকেট
কাঁচামাল 
রং, কাঠের গুঁড়া/ভুসি, কয়লার গুঁড়া, বিজলাগাছের ছাল, ডিপিই তেল, তরল সেন্ট, বাঁশের কাঠি

আগরবাতি তৈরির নিয়ম কানুন

১। চিকন করে মাপ মতো বাঁশ কেটে টুকরো করতে হবে। নরম কাঠি ব্যবহার না করাই ভালো। কাঠিগুলো রঙিন করতে চাইলে গামলায় রঙ গুলে কাঠিগুলো সেই রঙে ভিজিয়ে রঙিন করতে হবে। এগুলোকে আগরবাতির কাঠি বা শলাকা বলে।
খুলনা নগরীর শেখপাড়ার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয় আগরবাতির শলাকা। প্রতিদিন একজন কারিগর ৩-৪ কেজি শলাকা প্রস্তুত করতে পারে। প্রতি কেজি শলাকা মহাজনরা তাদের কাছ থেকে কিনে নেন ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। সেটা আবার ফ্যাক্টরির লোকদের কাছে ৪২-৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে এই দাম ৫-৮ টাকা করে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে খুলনা থেকে আগরবাতির শলাকা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, রাজশাহী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, খুলনার কপিলমুনির চালনা ও পাইকগাছার ফ্যাক্টরি মালিকরা কিনে নেন। আগরবাতির কাঠি আরও তৈরি করা হয় শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া গ্রামে।

২। বিজলা গাছের ছাল শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বাকলগুলো ভেঙে মেশিনে গুঁড়া করতে হবে অথবা শিল পাটাতে গুঁড়া করে নেওয়া যাবে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুধু রঙিন আগরবাতির জন্য কাঠের গুঁড়ার প্রয়োজন হয়। কালো আগরবাতি কয়লার গুঁড়া দিয়েই তৈরি করা যায়। কয়লা সংগ্রহ করে বেলুন দিয়ে পিষে গুঁড়া করে নেওয়া যায়। অথবা কয়লা গুঁড়া করার মেশিন যেখানে আছে সেখান থেকে সরাসরি গুঁড়া কয়লা কেনা যাবে। এরপর বিজলা গাছের ছাল ও কাঠের গুঁড়া বা কয়লার গুঁড়া আলাদা চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হবে। যদি বড় গুঁড়া থাকে তাহলে তা আলাদা হয়ে যাবে। এখন সব গুঁড়া আলাদা আলাদা করে দাড়িপাল্লা দিয়ে মেপে আলাদা বাটি বা প্যাকেটে রাখলে ভালো হবে। তাহলে কতটুকু পরিমাণ গুঁড়া আছে, তা জানা যাবে এবং কাজ করতে সুবিধা হবে। যদি রঙিন আগরবাতি তৈরি করতে হয়, তাহলে গুঁড়ার সঙ্গে রঙ মিশিয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত কালো সবুজ ও লাল রঙের আগরবাতি তৈরি করা হয়। তবে ইচ্ছে করলে নানা রঙের আগরবাতি তৈরি করা যাবে।

রাজধানী ঢাকার জুরাইনে অসংখ্য মানুষ এ ব্যবসার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত। প্রথমে হোটেলে হোটেলে আগে থেকেই কনট্র্যাক্ট করে রাখা হয়। সেই অনুযায়ী ছাই সংগ্রহ করে নিয়ে এসে আগে ভালো করে রোদে শুকাতে হয়। এতে সময় লাগে চার-পাঁচ দিন (আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল)। এরপর এই ছাই সূক্ষ্ম জালির চালনি দিয়ে মিহি করা হয়। এই ছাই বা কয়লার পাউডারের পাশাপাশি কাঠের গুঁড়ো, আগরগাছ-বিজলাগাছ-কাজলিগাছের বাকলের পাউডারও রোদে দিয়ে শুকাতে হয়। এরপর একসঙ্গে মিশিয়ে মেশিনে ভাঙিয়ে বস্তায় ভরে মহাজনদের কাছে বিক্রি করা হয়। গাছের ছালবাকল ভাঙানোর মেশিন ঘর খুঁজে পাওয়া যাবে দয়াগঞ্জ আর শনির আখড়ায়।
জুরাইন, দয়াগঞ্জ, শনির আখড়া থেকে শুরু করে সাদ্দাম মার্কেট হয়ে সানারপাড় পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কাঠের গুঁড়ো, কয়লার গুঁড়ো, বিজলা গাছের ছালের গুঁড়ো (আগর গাছ, কাজলিগাছ), বাঁশের কাঠি, রঙ, তরল সুগন্ধি ও পানি প্রয়োজন হয় আগরবাতি তৈরিতে। কয়লা দিয়া কাজ করলে ঝামেলায় পড়তে হয়, কারণ হোটেলে পোড়ানো কাঠ অনেক সময় আগেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই কয়লার মধ্যে পেরেক থাকে। পেরেকসহ কয়লা মেশিনে মিহি করা সম্ভব নয়। তখন কয়লা রোদে শুকিয়ে তারপর বড় আকারের একটা চুম্বক দিয়ে কয়লা থেকে পেরেক ও লোহাজাতীয় জিনিস আলাদা করা হয়।

বিজলাগাছের ছাল সাধারনত বরিশাল থেকে সংগ্রহ করা হয়। কয়লা সংগ্রহ করা হয় ঢাকার বিভিন্ন হোটেল থেকে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকেও কয়লা আসে। কাঠের গুঁড়ো স’মিল থেকে সংগ্রহ করা হয়। কয়লা ও কাঠের গুঁড়ো মিহি করতে বস্তাপ্রতি ১২০-১৫০ টাকা খরচ পরে। কাজলিগাছের বাকল মিহি করতে খরচ হয় ২৩০-২৫০ টাকা। তবে মেশিনে যতই ভাঙানো হোক, কিছু বড় অংশ থেকে যায়। তাই পাউডার চালনি দিয়ে চালতে হয়। গেন্ডারিয়ার দিকে খুঁজে পাওয়া যাবে এ শ্রমিকদের যারা এসব গুঁড়ো মিহি করতে চালনি দিয়ে চেলে থাকে।

৩। সব উপাদান ভালো করে সঠিক মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে পানি দিয়ে মাখিয়ে আটার দলার মতো করা হয়। যাকে লাছা বলা হয়। বিজলা বা আগরগাছের মিশেলের সঙ্গে বাড়তি কিছু দিতে হয় না, এমনিতেই আঠালো হয়ে যায়। তবে ছাইয়ের মিশেলের সঙ্গে বাড়তি আঠা ও পারফিউম ব্যবহার করা হয়।
*আসলে ডিপিই তেল দিয়ে মেখে আগরবাতি তৈরি করা উচিত। কিন্তু উৎপাদন খরচ আরও কমানোর জন্য ডিপিই তেলের বদলে শুধু পানি ব্যবহার করা হয়।

৪। রং মাখা কাঠের গুঁড়ো পিঁড়িতে রেখে, কাঠি তার ওপর রেখে ডলে ডলে মশলা কাঠিতে লাগাতে হবে। কাঠিতে মসলা লাগানোর সময় হাতে রঙিন গুঁড়ো লাগিয়ে নিতে হবে। মসলা মাখানোর পর পাশে রাখা ট্রেতে কাঠিগুলো রাখতে হবে। এরপর কাঠিগুলো রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ২-৩ ঘণ্টা শুকালেই হয়ে যায় আগরবাতি। সারা দিন কাজ করলে ২০ কেজি আগরবাতি বানানো সম্ভব। দুই মণ পরিমাণ আগরবাতি কাঠির বস্তা ৪ হাজার ৫০০-৫ হাজার টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। এক বস্তায় আগরবাতির কাঠি থাকে ৪৮ কেজি। কাঠিগুলো একসঙ্গে পরিষ্কার জায়গায় রেখে তরল সেন্ট/ সুগন্ধি আগরবাতিতে ছিটিয়ে মেখে দিতে হবে। আগরবাতিগুলো সঙ্গে সঙ্গে ১২টা করে সেলোফিন কাগজে-পলিথিনে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে শক্ত কাগজের প্যাকেটে রেখে দিতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণে প্যাকেটে ভরে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। গুণ, মান ও সুগন্ধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে আর আগরবাতি ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
অল্প পুঁজি নিয়ে ঘরে বসেই ছোট আকারে আগরবাতি তৈরি শুরু করা যায়। আগরবাতি তৈরি করে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে আয় করা সম্ভব।

খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, হাবীবুল্লাহ বাহার ইউনিভার্সিটি কলেজ, শান্তিনগর, ঢাকা

আরবি/ আরএফ

Link copied!