ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বন্ধ হোক বন্যা ট্যুর

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম

বন্ধ হোক বন্যা ট্যুর

ছবি: সংগৃহীত

শব্দটি ছোটো কিন্তু দুর্যোগ হিসেবে বন্যা খুবই ভয়াবহ। দেশে চলমান ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত বন্যার্তদের জীবনযাত্রা। এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে একতাবদ্ধ হয়েছে পুরো বাংলাদেশ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যে কাজ করছে দেশের অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের সঙ্গে মিলে অনেকে নিয়েছেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদ্যোগ। দেশের সাধারণ মানুষ; যারা নিজে উপস্থিত থেকে সাহায্য করতে পারছেন না, তারাও বিভিন্ন সেবা সংগঠনের মাধ্যমে অর্থদান করে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ছাত্র থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত যে যেভাবে পারছেন সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছেন। মানুষের এমন মানবিক সহায়তায় অনেকটা লাঘব হয়েছে বন্যার্তদের দুর্ভোগ।

ফেনী এবং লক্ষ্মীপুর থেকে দৈনিক রুপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জানান, থেমে গেছে বৃষ্টি; বন্যা থাকলেও কমতে শুরু করেছে এসব এলাকার পানি। স্বেচ্ছাসেবক এবং স্থানীয়দের সহায়তায় কমেছে মানুষের ভোগান্তি। চলছে সাহায্য কার্যক্রম; স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরতে আরও সময় লাগবে।

এদিকে নোয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এখনো উন্নতি হয়নি বন্যা পরিস্থিতির। স্থানীয়দের পাশাপাশি সহায়তার কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসছে খাবার, পোশাকসহ আর্থিক সহযোগিতা। তবে বিপর্যস্ত জনজীবন; কবে ফিরবে স্বস্তি, বলা যাচ্ছে না কিছুই।

পানিবন্দী হয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ করা, এবং তাদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কাজ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। যারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন তাদের প্রতি সারাদেশের মানুষের শ্রদ্ধা। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ এই মানবিক কার্যক্রমকে নিজেদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন; যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিশেষ করে, ত্রাণ দেওয়ার নামে বন্যাকবলিত এলাকায় ঘুরতে যাওয়া এবং বিনোদনমূলক কাজকর্মে মেতে ওঠা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি পোস্ট। রনি দেবনাথ নামের এক ব্যাক্তি তার প্রোফাইলে লিখেছেন, ‘আমি গত দুইদিন ফেনী শহরে ছিলাম। ফেনীতে অনেক নৌকা, অনেক স্পিড বোট, কিন্তু বেশির ভাগই কাজের না। শো-অফ করতে আসছে। সেলফি তুলতে আসছে তারা। ১৫ জন ধারণ ক্ষমতার একটা নৌকায় তারাই ছিলো ১২ জন। ওরা নাকি মানুষ উদ্ধারের জন্য আলোকদিয়া যাচ্ছে। আমরা কয়েকজন মিলে ৪ জন নৌকায় রেখে বাকি সবাইকে আমার সাথে রেখে দিছি। এ ছাড়া এমন অনেক নৌকা ছিলো যাদের কতো অনুনয় করলাম আমাকে সাথে নেন; আমি এইসব এলাকা চিনি; আপনারা চিনবেন না। একটা টিমকেও রাজি করাইতে পারলাম না।’

ফেসবুকে ইয়ামিন কাদের নিলয় লেখেন, ত্রানের টাকায় ট্যুর দিতে যাচ্ছে। মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসব বন্যা ট্যুর বন্ধ হোক। আপনার কষ্টে অর্জিত টাকা এমন কোন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানকে দান করুন যেন তার সুষ্ঠু বন্টন হয়। বন্যার্তদের সহায়তার নামে এমন প্যাকেজ ট্যুর দেওয়া বন্ধ করুন। নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিন, মানবিক হন। বিপদের দিনে এমন পরিস্থিতিতে সহায়তার নামে ট্যুর দেওয়া বন্ধ করুন।

সোলায়মান নামে অপর ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে একটা গাড়ি নিয়ে ৬ জনের টিম গিয়ে ৩০ হাজার টাকা ভাড়ায় খরচ করে ২০ হাজার টাকা ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টা খুবই বিব্রতকর। কারণ এদেশে অসংখ্য ট্রাস্টেড জায়গা আছে টাকা দেওয়ার। সেগুলোতে দিয়ে দিলেই হয়। ২০ জন মিলে ২০জন ক্যাপাসিটির নৌকা নিয়ে উদ্ধার করতে গিয়ে সেই নৌকাতেই ২০ জন উঠে বসে বসে সেল্ফি, ভিডিও, ফটোসেশান আর রিলস বানাচ্ছেন! এই বন্যা ট্যুর বন্ধ হোক!

বন্যা চলাকালীন সময়ে যখন এলাকাবাসী নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে; ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত অবস্থায় দিন পার করছে; তখন কিছু মানুষ সেখানে গিয়ে ভিডিও তৈরি করছে। তারা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলোয়ার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে; ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সামনে কিংবা বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মজার ভিডিও তৈরি করছে। এটি শুধু অনৈতিক নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি অসম্মানজনকও।

ত্রাণ বিতরণ এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজ। যখন মানুষজন ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন সেই পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে নিজেদের বিনোদনের উদ্দেশ্য হাসিল করা প্রায় অপরাধের শামিল। এটি শুধু স্থানীয়দের অনুভূতিতে আঘাত করে না। বরং যারা সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে যাচ্ছেন তাদের কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়াও, এরকম কর্মকাণ্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজে জটিলতা সৃষ্টি করে, যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করে।

যারা এই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন, তাদের সচেতন হওয়া উচিৎ। বন্ধ হোক বন্যা ট্যুর। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখা নয়; বরং সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন। কেউ যদি সত্যিকার অর্থে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চায়, তাহলে বিনোদনের চিন্তা বাদ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। দুর্যোগকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব।

আরবি/জেডআর

Link copied!