ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ইচ্ছে পূরণে তাসরিফ খানের স্বপ্ন

আরফান হোসাইন রাফি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৫, ১১:৪৯ এএম

ইচ্ছে পূরণে তাসরিফ খানের স্বপ্ন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

হাওয়ায় ভাসা পাখিদের ডানার উল্টে থাকা প্রান্তর থেকে আমরা স্বপ্ন দেখি, বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ থেকে আসমানের সুউচ্চ সীমানায়, স্কারলেট ম্যাকাও পাখির মতো জমকালো দৈহিক গঠন নিয়ে উড়তে দেখি নিজেকে। স্বপ্ন দেখা খারাপ কিছু নয়; কারণ স্বপ্ন দেখা এবং তা সফল করার অধিকার সবার আছে। তবে সে স্বপ্ন যদি হয় অন্যের স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে, তাহলে কেমন হয়? এমন স্বপ্নই দেখেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট তাসরিফ খান। অন্যের ইচ্ছে বা স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে তিনি খুঁজে নেন, তার স্বপ্নের সোপান। সেসব স্বপ্নের গল্প জানাতে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। তুলে ধরেছেন- আরফান হোসেন রাফি

আমি আসলে অনেক বড় স্বপ্ন দেখা মানুষ না, আমি একজন বাস্তববাদী মানুষ। ছোটবেলা থেকে বাস্তবতাকে বরণ করে নিতে শিখেছি। যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান; অভাব-অনটন দেখেই আমার বেড়ে ওঠা। এখনো চোখ বন্ধ করলে ছোটবেলার একটি ঘটনা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি ১ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে এক জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে এসেছিলাম বাকির দোকান থেকে; তখন ঈদের আগে বাকির দোকান থেকেই কেনাকাটা করা হতো। বাসায় আসার পর স্যান্ডেলটা নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল, কারণ ১ হাজার ৬০০ টাকা তখনকার সময় অনেক টাকা। আবার যেহেতু অভাব-অনটনের সংসার! তবে ঈদের আমেজে অনেক দিন পরব এই ভেবে আমি স্যান্ডেলটা খুব পছন্দ করে কিনেছিলাম। কিন্তু যখন শুনি এটি নিয়ে বাসায় একটু আলাপ-আলোচনা হচ্ছে এবং ব্যাপারটা আব্বু-আম্মু পছন্দ করেননি, তখন সে স্যান্ডেলটা আমার আবার ফেরত দিতে হয়। ব্যাপারটা তখন আমাকে তীব্র আঘাত করেছিল, সামর্থ্যের কারণে আমার স্যান্ডেলটা ফেরত দিতে হয়েছে। তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল, যখন টাকা উপার্জন করতে পারব, আমার পরিবারের মুখে হাসি ফোটাব এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়াব। এর কয়েক বছর পর সম্ভবত টিভিতে একটা প্রোগ্রাম দেখেছিলাম, ইচ্ছে পূরণ টাইপের সিমিলার কিছু একটা। যেখানে কোনো একজনকে নিয়ে যায় এবং তার বেশ কিছু আশা পূর্ণ করে। তখন আমি ভেবে রেখেছিলাম, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ইচ্ছেগুলো আমিও একদিন পূরণ করব। এভাবেই স্বপ্নটা দেখা। তারপর যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছি। তবে ইচ্ছে পূরণে অনেক বড় পরিকল্পনা নেই। কারণ, আমি আসলে একদিন করে চিন্তা করি; আমি শুধু একটা জিনিস চাই, আমার এই মেন্টালিটি সবসময় থাকুক, যে মানুষের মুখে আমি হাসি ফোটাতে চাই। সেটা হোক অল্প কিংবা বেশি খরচ করে। এভাবেই এক পা, দুই পা করে আগাচ্ছি। যখন আমি অন্যান্য সোশ্যাল প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি, যেমন: ইচ্ছে পূরণ দিয়ে আমার শুরু, এরপর আমি টুকটাক মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, কোভিডের সময় কাজ করে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর সিলেটে যখন আমি বন্যার সময় কাজ করেছি, সেখানে একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মাথায় আসে, ইচ্ছে পূরণটা তো হয় একদিনের, শুধু একদিনের আনন্দ! তাই ভাবতে শুরু করলাম, এমন কিছু করা যায় কি না, যেটাতে কারও পারমানেন্ট উপকার হয়। অনেকে কমেন্টেও বলত, ‘ভাই, এমন কিছু করেন, যাতে সে চলাফেরা করে খেতে পারে।’ তখন মনে হলো, ইচ্ছে পূরণে আমি যে অর্থ খরচ করি, উদাহরণস্বরূপ, ২০-৩০ হাজার টাকা হোক বা ৫০ কিংবা এর বেশি। এ টাকায় তো তাহলে একটা মানুষকে স্বাবলম্বী করে দেওয়া যায়। যেমন- ৭০-৮০ হাজার টাকায় একটা গরু কিনে দেওয়া যায়, ৩০ হাজার দিয়ে ছাগল কিনে দেওয়া যায় অথবা ২০ হাজার দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া যায়। তাই পরবর্তী সময়ে ইচ্ছে পূরণের পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার একটা উদ্যোগ নেই। এটি ছিল আমার ফেসবুকে ৭ মিলিয়ন ফলোয়ার উপলক্ষে ৭ জনকে স্বাবলম্বী করার একটি পরিকল্পনা। কিন্তু এখন আল্লাহর রহমতে সংখ্যাটা বেশ ভালোই দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটা আমি সারা জীবন করতে চাই, যত দিন বেঁচে থাকব। অনেক কিছু আমি ভিডিও করি, অনেক কিছু করা হয় না। ক্যামেরার সামনে হোক বা  পেছনে, সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। কাউকে কিছু করে দিতে পারলে মনের  ভেতর একটা শান্তি অনুভব করি। সে-ই ভালো লাগা থেকেই এসব কাজ করা। এত দিন সেবামূলক কাজ করতে গিয়ে অনেক করুণ গল্পের সম্মুখীন হয়েছি। মোটা দাগে বললে দেখা যায়, একজন মা তার বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য আকুতি করছে, যে আমি যদি একটা ভিডিও করে তাদের বিকাশ নম্বরটা দিয়ে কিছু টাকা উঠিয়ে দিই অথবা কখনো কোনো ছেলে হয়তো মায়ের জন্য বলছে, ‘আমার কিডনিটা দিয়ে দেব ভাই, কিন্তু কিডনি যে দেব, সে অপারেশনের টাকাটা নাই!’ এরকম অসংখ্য অনুরোধ আসে। কিন্তু আমারও তো একটা লিমিটেশন আছে, আমিও তো একজন মানুষ। আমার গানের কাজ, ব্যবসার কাজ, নানারকম ঝুটঝামেলা সেরে অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এমনও হয়, যাকে আমি লিস্ট করে রাখি, দেখা যায় আমরা কাজ করার আগেই শুনি, সে মারা গেছে! সেটা খুবই খারাপ লাগে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না! সাম্প্রতিক একটা ঘটনা যদি শেয়ার করি, একজন মানুষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নেত্রকোনা বাড়ি, গাজীপুরে থাকে। উনার বাচ্চাটা অসুস্থ! উনি নিজেও অসুস্থ হওয়ায় কিছু করতে পারছেন না, তাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এখন একটা জিনিস কি হয়, আমি তো মানুষের কাছ থেকে চেয়ে টাকা নেই। তাই এখানে ভেরিফাই একটা প্রসেস থাকে। উনি সেই ভেরিফাই প্রসেসটার মধ্যে ছিলেন। আমার ইচ্ছে ছিল আমি কাজটা করব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আনুষঙ্গিক কিছু কারণে আমার বিলম্ব হচ্ছিল। কিন্তু আমার নিয়ত ছিল আমি কাজটা করব। সেই অনুযায়ী মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছি। তারপর সেই তারিখে দুইটা শো চলে আসে। এর মধ্যে উনি জানিয়েছিলেন, তার বাচ্চাটা অসুস্থ। আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দিই, হাসপাতালে নেওয়া এবং ওষুধপত্রের জন্য। আমার পরিকল্পনা ছিল বাচ্চাটার জন্য টাকা তুলে দিয়ে, তাকে স্বাবলম্বী করে দেওয়ার। তাই উনাকে বলেও ছিলাম দোকানের জন্য জায়গা দেখতে। আমি মোটামুটি লাখখানেক টাকার মতো একটা বাজেট করেছি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আমি যে টাকা পাঠিয়েছিলাম, হাসপাতালে নিয়ে ওষুধপত্র কেনার জন্য, সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাটার কাফনের কাপড় কিনতে হয়েছে। আমি প্রজেক্টটা করার আগেই বাচ্চাটা মারা গেছে! আমি জানি না আমি আসলে অপরাধী কতটুকু! কিন্তু আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে। আমি কেন আগে করতে পারলাম না! যদিও জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তাও একটা আক্ষেপ থেকে গেছে, ইস! বাচ্চাটা চলে যাওয়ার আগে একটু যদি সুখ করতে পারত! ঘটনাটি আমাকে অনেক নাড়া দিয়েছে। যেহেতু আমি ক্রিয়েটিভ সেক্টরের মানুষ, সে ক্ষেত্রে এসব ইমোশনাল ঘটনাগুলো আমার জীবনটা কিছুটা ডিফিকাল্ট করে তুলছে। জানি না, কতটুকু পারব! কিন্তু চেষ্টা করে যাব; বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

যোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বাংলাদেশে থাকবে না। যদিও আমার পক্ষে এটি সম্ভব না, কিন্তু এ ধরনের মানুষদের নিয়ে কাজ করলে তাদের মুখে হাসি ফুটলে আমার ভালো লাগে; তাই সাধ্যমতো চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস, আমার ভিডিও দেখে হোক বা যেকোনোভাবে হোক, আরও মানুষ যদি এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসে, তাহলে একদিন সবার ইচ্ছে পূর্ণ হবে। যারা অর্থের জন্য কিছু করতে পারে না, সবার ইচ্ছে পূর্ণ হোক, আমাদের সমাজে বৈষম্য না থাকুক; আমরা চাইলেই সম্ভব।’ 

আরবি/ আরএফ

Link copied!