ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৪

কালের সাক্ষী ও স্মৃতি ধূসর তিন জমিদার বাড়ি

আহাদ তালুকদার

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২৪, ০৪:৪৪ পিএম

কালের সাক্ষী ও স্মৃতি ধূসর তিন জমিদার বাড়ি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কালের স্রােতে হারিয়ে যাচ্ছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী গ্রামের জমিদার অন্মিকা চরন গুহ, কেদারনাথ বসু ও অন্যদা বসুর সকল ঐতিহাসিক নির্দশন। তিনজন জমিদার একইগ্রামে বসবাস করে তাদের জমিদারী পরিচালনা করলেও তাদের মধ্যে ছিলোনা কোন বিরোধ। ছিলো সু-সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে পাক সেনারা জমিদার অন্যদা বসুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে মন্দির ও তাদের দালানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ওইসময় পাকসেনাদের হামলার কবল থেকে রেহাই পেতে পাশ্ববর্তী রাংতা এলাকার কেতনার বিলে পালাতে গিয়ে জমিদারের ছোট ভাই স্বপন বসু, বোন শেফালী ও জুথিকা বসু গুলিবিদ্ধ হয়ে একইসাথে শহীদ হয়েছেন।

চাঁদশী গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে দেশ বিভক্তির পর জমিদাররা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছেন। পরবর্তীতে তারা আর ফিরে আসেননি। এ সুযোগে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমিদারদের সহায় সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন। তারা নিজেদের স্বার্থে জমিদার বাড়ির পূজা মন্ডপ, সমাধি মন্দির ও দালান কোঠাসহ জমিদার বাড়ির সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

জমিদার অন্বিকা চরন গুহ

উত্তর চাঁদশী গ্রামের প্রয়াত জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জমিদারের সমাধীর নিচের অংশটি দখলদাররা ভেঙ্গে ফেলেছে। সমাধীর ইট ও খোয়া দিয়েই মাত্র ৪/৫ গজ দুরত্বে তৈরি করা হয়েছে একটি শৌচাগার। শ্বেত পাথরের তৈরি কারুকার্য খচিত পঞ্চরত্ন নামের সমাধিটি নির্মিত হয়েছিলো বাংলা ১৩১৮ সালে। প্রায় ৩৫ ফুট সু-উচ্চ এ সমাধি মন্দিরের উপরিভাগে নির্মিত হয়েছে চারটি গম্বুজ। ১৩০১ সালে জমিদার অন্বিকা চরন গুহ মৃত্যুবরন করেন। তিনি বাড়ির সম্মুখভাবে খনন করিয়েছিলেন বিশাল দীঘি। ওই দীঘিটি গুহ বাড়ির দীঘি নামে এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। দীঘির উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে তৈরি করা হয় বিশাল ঘাটলা। প্রায় ১১ একর জমির ওপর জমিদার অন্বিকা চরন গুহর বাড়িটি। ওই বাড়িতে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের ছয়টি পুকুর রয়েছে। জমিদার অন্বিকা চরন গুহ থাকতেন দ্বীতল ভবনে। বাড়িতে ছিলো জমিদারের দাওয়াখানা ও দূর্গা মন্দির। বাড়ির আশপাশে বাদ্যকর, নাপিত, ধোপা ও পাইক-পেয়াদারা থাকতেন। জমিদার বাড়িটি বারো মাসেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকতো। অনুষ্ঠানের আগে পঞ্চরতেœর ওপরে বসে ঢ্যাড়া পিটিয়ে এলাকার লোকজনদের দাওয়াত দেয়া হতো। সূত্রমতে, অন্বিকা চরন গুহ চার ছেলে ছিলো। তারা হলেন-রাইচরন গুহ, বিমল গুহ, কালি প্রসন্ন গুহ ও নলিনী গুহ। বিমল গুহ ছিলেন জেলা জজ।

জমিদার কেদারনাথ বসু

জমিদার অন্বিকা চরন গুহর বাড়ির উত্তর পার্শ্বে মাত্র কয়েক’শ গজ দুরত্বে জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ি। দ্বীতল ভবনে জমিদার থাকতেন। কারুকার্য খচিত ভবনের দেয়ালের চুনকাম খসে পরেছে। বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে বৌ-ঠাকুরানীর দীঘি। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে পাকা ওয়াল ঘেরা শান বাঁধানো ঘাটলা। জমিদার তার নিজের স্ত্রী কাদন্বীনী বসু মজুমদারের নামে দীঘিটি খনন করেছিলেন। কেদার নাথ তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেন চাঁদশী ঈশ্বর চন্দ্র বসু মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালে জমিদার দেশত্যাগ করেন। ওই স্ট্রেটের কেয়ারটেকার ছিলেন জিতেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। বর্তমানে ওই বাড়িতে তার (জিতেন্দ্র নাথ) চার ছেলে বসবাস করছেন। জমিদার কেদার নাথের বাড়িতে তিনখানা দুর্গাপূজা হতো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পূজা উপলক্ষে জমিদার বাড়িতে নাচ, গান ও যাত্রানুষ্ঠানে মুখর থাকতো। জমিদার কেদারনাথের কালি দাস বসু নামের এক ছেলে ছিলো। তিনি ভারতে চলে যাবার পর মারা গেছেন। তাদের জমিদারি চলতো বিল্লগ্রাম, বাশাইল, ধানডোবা ও চাঁদশী এলাকায়। খাজনা আদায়ের জন্য তাদের বিভিন্নস্থানে কাছারি ছিলো। জমিদার গুহ পরিবার ও বসু পরিবার চাঁদশী হাটের মালিক ছিলেন।

জমিদার অন্যদা বসু

জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ির পূর্ব পার্শ্বেই আরেক জমিদার অন্যদা বসুর বাড়ি। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন জমিদার অন্যদা বসুর নাতী (মুকুন্দ নাথ বসুর ছেলে) তপন বসু। এ বাড়িটি দারোগা বাড়ি নামে সবার কাছে পরিচিত। তপন বসু একাই আট একরের জমিদার বাড়ির বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করছেন। ভবনটির বেহাল দশা, তাই তিনি কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলেছেন। এ বাড়ির রাধা কৃষ্ণের বিশাল মন্দিরটি এখনও সবার দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৪৮ সালে দেশ বিভক্তির পর জমিদার অন্যদা বসু ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী অন্যদা বসুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে মন্দির ও তাদের দালানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছিলো। ওইসময় পাকসেনাদের হামলার কবল থেকে রেহাই পেতে পাশ্ববর্তী রাংতার কেতনার বিলে পালাতে গিয়ে ১ জৈষ্ঠ অন্যদা বসুর ছোট ভাই স্বপন বসু, বোন শেফালী ও জুথিকা বসু গুলিবিদ্ধ হয়ে একসাথে শহীদ হন। বাড়ির লোকজন ওইসময় সহদর তিন শহীদকে বউ ঠাকুরানীর দীঘির পাড়ে মাটি চাঁপা দিয়ে রাখেন। শহীদ স্বপন বসু তখন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র। আর শেফালী ও জুথিকা ছিলো চাঁদশী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী। জমিদারের নাতী তপন বসু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাদের বাড়িতে স্থানীয় রাজাকারদের ইশারায় পাক সেনারা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে।

চাঁদশী গ্রামের তিন জমিদারের বাড়ির আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে জমিদারদের নানা স্মৃতি। প্রত্যেক জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে আলাদা রাস্তা ও খাল। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, তিনজন জমিদার একইগ্রামে বসবাস করে তাদের জমিদারী পরিচালনা করলেও তাদের মধ্যে ছিলোনা কোন বিরোধ, ছিলো সু-সম্পর্ক। ১৯১৫ সালে জমিদার কেদার নাথ বসু তার বাবার নামে চাঁদশী ঈশ্বর চন্দ্র বসু মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সময় অপর জমিদার অন্বিকা চরন গুহর বড় ছেলে রাইচরন গুহ তাকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছেন। তারই (রাইচরন) প্রদানকৃত একটি কাঠের আলমিরা আজও চাঁদশী স্কুলে স্মৃতিবহন করছে। কালের বির্বতনে ও দখলকারীদের উদাসিনতায় ক্রমেই বিলিন হয়ে যাচ্ছে চাঁদশীর তিন জমিদারের সকল স্মৃতি।

আরবি/জেআই

Link copied!