প্রকৃতি জীবকুলের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। উদ্ভিদ, প্রাণী, মাইক্রোব এবং অন্যান্য জীব একে অপরের সঙ্গে জৈবিক সম্পর্ক বজায় রেখে বাস করে। এই সম্পর্কগুলোর সমষ্টিকে বলা হয় জীববৈচিত্র্য। বর্তমান বিশ্বে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি। এই বিলুপ্তি কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নয়, মানব সভ্যতার অস্তিত্বের ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে জীববৈচিত্র্য অপরিহার্য। বিখ্যাত প্রাইমেটোলজিস্ট জেন গুডঅল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে বলেছেন, ‘জীবজগতের প্রতিটি সদস্যের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সংযুক্ত।’ আর তাই একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রজাতিও প্রভাবিত হয়। যেমন- ফুলে মধু সংগ্রহ করা মৌমাছি বিলুপ্ত হলে পরাগায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, যা খাদ্য উৎপাদনে সংকট তৈরি করবে। এভাবে খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়লে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ড. বদরুল ইমাম জানান, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা না করলে আমাদের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।’
জীববৈচিত্র্যে বিলুপ্তির পেছনে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুইটি কারণই রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, মহাজাগতিক ধাক্কা, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে মানুষের কার্যকলাপই এই সমস্যার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কৃষিকাজ, নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের জন্য বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, যার ফলে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। বায়ু, পানি এবং মাটির দূষণ প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। রাসায়নিক বর্জ্য এবং প্লাস্টিক দূষণের কারণে জলজ প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে অনেক প্রজাতি তাদের প্রাকৃতিক আবাস থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন হওয়ায় প্রজনন, খাদ্য শৃঙ্খল এবং বাস্তুতন্ত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বাণিজ্যিক শিকার এবং অবৈধ পাচারের ফলে বাঘ, গণ্ডার এবং হাতির মতো অনেক প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
জীববৈচিত্র্য পরিবেশগত সেবা যেমন বায়ু পরিশোধন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় সহায়তা করে। বিভিন্ন ঔষধি গাছপালা ও প্রাণীর মাধ্যমে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ওষুধও পেয়ে থাকে। তাই জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হলে স্বাস্থ্য, খাদ্য, ওষুধসহ মানবজীবনের বহু দিকই বিপর্যস্ত হবে। পরিবেশের প্রতি মানবজাতির দায়িত্ব সম্পর্কে মার্কিন জীববিজ্ঞানী ও লেখক র্যাচেল কারসন তার লেখা ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইয়ে বলেন: ‘প্রকৃতি তার নিজস্ব ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। তবে মানুষের ক্রিয়াকলাপ সেই ভারসাম্য ভেঙে ফেলছে, যা অবিলম্বে সমাধান করা প্রয়োজন।’
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নীতি-নির্ধারণী স্তর থেকে ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাদের মতে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-
- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিভিন্ন সুরক্ষিত অঞ্চল, যেমন জাতীয় উদ্যান ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে
- বনভূমি পুনরুদ্ধার এবং সবুজায়নের উদ্যোগকে জোরদার করতে হবে
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
- শিকার এবং পাচার রোধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে
- কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করতে হবে
বিশেষজ্ঞদের মতে, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির প্রভাব জীবকুলের জন্য সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর। এটি পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, যার ফলশ্রুতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পৃথিবী রেখে যেতে হলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকার, সংস্থা এবং সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখনই সচেতন উদ্যোগ না নিলে প্রকৃতির যে অসীম সেবা মানুষ পাচ্ছে, তা একসময় ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :