ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঘাঘট নদী

ঐতিহ্য, সংকট ও সম্ভাবনা

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৪, ০৪:২১ পিএম

ঐতিহ্য, সংকট ও সম্ভাবনা

ছবি: ইন্টারনেট

ঘাঘট নদী উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সংযোগস্থলে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদী হিসেবে পরিচিত। এই নদী তিস্তার শাখা নদী, যার উৎপত্তি নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুজিপাড়া গ্রামে। নদীটি রংপুর সদর উপজেলা অতিক্রম করে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করে এবং পরে আলাইপুরী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার রসুলপুরে প্রবেশ করে। এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে এটি গাইবান্ধা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। অধ্যক্ষ জহুরুল কাইয়ুম দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘাঘট নদীটি গাইবান্ধা শহরের মূল নদী। উজানে ব্রহ্মপুত্র এবং ভাটিতে যমুনা থাকায় অতীতে নৌপথে চলাচল কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এছাড়া নদীটি কেবল পরিবহন ও বাণিজ্যের জন্যই নয়, বরং কৃষি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’

 

অতীতের ঐতিহ্য
একসময় ঘাঘট নদী ছিল উচ্ছ্বাসপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত। নৌপথে এই নদী দিয়ে বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হতো, যা স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশে ভূমিকা রাখত। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যাতায়াতের জন্য নদীটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি গাইবান্ধা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মূল মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে গাইবান্ধার যোগাযোগের সেতুবন্ধন ছিল। সেই সময়ে নদীর স্রোতস্বিনী ধারা চারপাশের জমি উর্বর করত এবং কৃষি, মৎস্য শিকারসহ জীবিকার জন্য অপরিহার্য ছিল।


বর্তমান সংকট
ঘাঘট নদীর বর্তমান চিত্র অতীতের ঐতিহ্য থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। নদীর নাব্য কমে যাওয়া এবং দূষণের কারণে এটি এখন মৌসুমী নদীতে পরিণত হয়ে পড়ছে। শহরের পূর্বদিকে নদীটির আদি খাত লুপ কার্টিং পদ্ধতিতে ব্রহ্মপুত্রে সংযোগের চেষ্টা চলছে, যার মাধ্যমে শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা করা যাবে। পাশাপাশি, মূল নদীটি বন্ধ করে সেটিকে ‘ঘাঘট লেক’ নামে একটি লেকে রূপান্তর করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষ জহুরুল কাইয়ুম উল্লেখ করেছেন, ‘এলজিইডি এবং গাইবান্ধা পৌরসভার তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে ঘাঘট লেকের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু সেটা উপযোগী হচ্ছে না এখনো। তবে গাইবান্ধার বর্তমান জেলা প্রশাসক কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছেন।’ এই প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদা বেগম জানান, ‘লেকের পানির দূষণের কারণে এখানে খুব বেশি মানুষের যাতায়াত নেই। ফলে জায়গাগুলো বখাটে লোকজনের আড্ডার জায়গায় পরিণত হয়েছে। এলাকাবাসী চায় লেকটিকে দ্রুত সংস্কার করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত  করা হোক।’


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ঘাঘট নদীর পুনরুদ্ধার এবং লেক প্রকল্প সম্পন্ন হলে এটি গাইবান্ধার জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই নদীকে পর্যটন, বিনোদন এবং জলাধার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এলাকাবাসীর দাবি অনুযায়ী, লেকটির পানি দূষণমুক্ত করে সেখানে পার্ক, হাঁটার পথ এবং নৌকাবিহারের ব্যবস্থা করলে এটি গাইবান্ধা শহরের মানুষের জন্য একটি জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
তবে অতীতের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু লেক তৈরি নয়, পূর্বদিকে নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া, স্থানীয়দের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে ঘাঘট নদী ও লেক প্রকল্পটি একটি সফল উদাহরণ হতে পারে।

 

ঘাঘট নদী গাইবান্ধার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মানুষের জীবনের অংশ। যদিও বর্তমানে এটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তবে সঠিক উদ্যোগ নিলে ঘাঘট আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবিদ এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই নদীকে আবারও জীবন্ত করে তুলতে পারে, যা গাইবান্ধার মানুষের জন্য একটি আশীর্বাদস্বরূপ হবে।

আরবি/ এম এইচ এম

Link copied!