ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী মোয়া-মুড়ি

দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম

ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী মোয়া-মুড়ি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে মানুষের রুচি, চাহিদা আর খাদ্যাভ্যাস। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী চিড়া-মুড়ির মোয়া, নাড়ু ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী যেন এখনো সমান জনপ্রিয়। তাই এখনো মানুষ ছুটে চলে এর টানে। প্রাচীন ও সুস্বাদু এসব খাবার তৈরির সব উপকরণ যেমন চাল, ময়দা, গুড়, চিনি, সুজি, দুধ, নারিকেল, তিল ও অন্যান্য সামগ্রীর আকাশছোঁয়া দামের কারণে আর ফাস্ট ফুড নামের কথিত আধুনিক খাবারের কারণে মানুষ কিছুটা পিছু হটলেও আবার ফিরে আসছে নাড়ির সেই চিরাচরিত টানে।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল এলাকায় কথা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোয়া বিক্রেতা তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। তিনি যশোরে বাসাভাড়া করে তৈরি করেন মুড়ি আর চিড়ার মোয়া। এসব মোয়া বানাতে তার মূল উপকরণ চিড়া বা মুড়ি, গুড় বা চিনি, তিল, নারিকেল ইত্যাদি। তিনি জানালেন, বাজারে এতসব নতুন নতুন খাবার বা ফাস্টফুড বিক্রি হলেও শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও তার মোয়া বেশ জনপ্রিয়। তিনি এবং আরও ৫ জন সহকারী নিয়ে চালাচ্ছেন তার কারখানা। বৃহত্তর যশোরের বিভিন্ন জেলা ও পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের বিভিন্ন এলাকায়  তার দল পৌঁছে যায় চিড়া-মুড়ির মোয়ার পসরা নিয়ে। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়ে, বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ খরিদ্দার, জানালেন মোয়া বিক্রেতা তোফাজ্জল হোসেন।

ঝিনাইদহ সহর উপজেলার কালিচরণপুরের কয়েকজন হিন্দু রমণী জানালেন, তারা চিড়া-মুড়ির মোয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির ছাতুর নাড়ু, তিলেখাজা ইত্যাদি পরিবারের নাস্তা এবং অতিথি আপ্যায়নের জন্য তৈরি করে থাকেন। নিকটাত্মীয়দের বাড়িতেও এসব বিভিন্ন পার্বণে পাঠানো হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার পরদিন বা বাদদশমী, লক্ষ্মীপূজায় এবং অন্যান্য পূজায় এসব মিষ্টি-মিঠাইয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব দুটোই আছে। এসব নাড়ু, বিশেষ করে তিলের নাড়ু বিদেশে অবস্থানকারী বাঙালিদের কাছে খুব জনপ্রিয় বিধায় তাদের বৎসরের চাহিদা মেটাতে তারা নিয়মিত তা বানিয়ে থাকেন।

মোহিনী রায় নামের এক গৃহবধূ জানালেন, মুড়ি, মোয়া ও অন্যান্য দেশীয় জলখাবারের চাহিদা ব্যাপক থাকলেও দিন দিন তা কমে যাচ্ছে। শহরের মানুষের মতো গ্রামের মানুষের চাহিদারও পরিবর্তন হওয়ায় এবং কোম্পানির খাবারসহ ফাস্ট ফুড, পিৎজা এসবের প্রচলন হওয়ায় গ্রামেও শহরের হাওয়া লেগেছে। তা ছাড়া, চিড়া, মুড়ি, নারিকেল, গুড়, চিনি, দুধ, সুজি, তিল ইত্যাদির দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে তাদের ঐতিহ্যেও তা আঘাত হানছে। ফলে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা ঐতিহ্যবাহী দেশীয় মিষ্টি-মিঠাইয়ের ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশের বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও মাগুরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. অলোক কুমার সাহার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানালেন, চিড়া-মুড়ি, তিল আর নারিকেলের তৈরি যেকোনো খাদ্যসামগ্রী বাংলার ঐতিহ্য ধরে রখেছে। এমন এক সময় ছিল যখন এসব ছাড়া দিনের জলখাবার, অতিথি আপ্যায়ন ও কুটুম্বদের বাড়িতে লৌকিকতা করার বিকল্প ছিল না। এসব খাবার ছিল অপিরিহার্য শিশুতোষও। কিন্তু কালের বিবর্তণে এখন এসব খাবারের জায়গা অনেকটাই নিয়েছে ফাস্ট ফুড নামের একপ্রকার খাবার যা মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের অনেক ক্ষেত্রেই মোটা বানিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন ভেজাল খাবারের পাশাপাশি কথিত অধিকাংশ ফাস্ট ফুডের কারণে মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের আন্ত্রিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। নিরোগ জাতি গঠনে মানসম্মত খাবার শিশুদের নিশ্চিত করতে মুড়ি-মুড়কির মতো খাবারসহ সব খাবারই বেশ সতর্কতার সঙ্গে তৈরি ও পরিবেশন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. অলোক কুমার সাহা।

আরবি/ আরএফ

Link copied!