বাংলাদেশে কালের সাক্ষী হয়ে বিখ্যাত যে কয়েকটি প্রাচীন স্থাপত্য এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর নিদর্শন কান্তজিউ মন্দির। দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত এই মন্দিরটি মধ্যযুগের স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী রুক্সিণীকে উৎসর্গ করে নির্মিত করেন। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে মন্দিরের কাজ শেষ হয়। এ মন্দিরে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সুদূর পারস্য থেকে নির্মাণ শিল্পীদের এনে পৌরাণিক কাহিনিসমূহ দ্বারা পোড়ামাটির অলঙ্করণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেয়ালের গা। প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাসব্যাপী রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, মহারাজা রামনাথ রায়ের সময়কাল থেকেই এই রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা চলাকালীন অনেক তীর্থযাত্রী ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেন। ওপর থেকে মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে রামায়ন, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি চিত্রায়ন করা আছে। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫ হাজারের মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে। এ ছাড়াও মন্দিরের চারটি দেয়ালে চারটি আলাদা শাস্ত্রীয় যুগের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে এসব টেরাকোটায়। যুগগুলো হচ্ছে- সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। শুধু পৌরাণিক কাহিনিই নয়, বরং মুঘল বাদশাহদের কর্মকাণ্ড, তৎকালীন সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র এবং জমিদার কিংবা অভিজাত বংশীয় সমাজব্যবস্থা স্পষ্ট প্রতিফলন হয়েছে এসব টেরাকোটায়। পোড়ামাটির এসব শিল্প অত্যন্ত দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই মন্দিরের শৈল্পিক বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে। তাই মধ্যযুগের নান্দনিক সৌন্দর্য, স্থাপত্যশৈলীর প্রাচুর্য দেখতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীর দেখা মিলে। মধ্যযুগের ছোঁয়া পেতে ছুটির দিনে আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক মন্দিরে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন, এবং বিমান তিনভাবে যাওয়া যায় দিনাজপুর। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, আসাদগেট, কলেজগেট, শ্যামলী, টেকনিক্যাল মোড়, এবং উত্তরা থেকে পাওয়া যাবে দিনাজপুরের বাস। প্রায় সারাদিনই ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পরপর গাড়িগুলো দিনাজপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায়। নন-এসি এবং এসি কোচগুলোর ভাড়া হতে পারে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
ট্রেনে যেতে হলে ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাওয়া যাবে দিনাজপুরের ট্রেন। অধিকাংশ ট্রেনগুলো সন্ধ্যা ৭টা ৪০ এবং সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে। শ্রেণিভেদে এই ট্রেনগুলোর টিকিট মূল্য নিতে পারে ৫৭৫ থেকে ১ হাজার ৯৭৮ টাকা পর্যন্ত। আকাশপথে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি সৈয়দপুরের বিমান রয়েছে। আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোতে খরচ পড়তে পারে সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৭৯৯ থেকে ৫ হাজার ৩২৫ টাকা পর্যন্ত। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে অথবা পাবলিক বাসে সরাসরি কান্তজিউ মন্দির যাওয়া যায়। বাস ও ট্রেন যাত্রার ক্ষেত্রে দিনাজপুর সদর থেকে সরাসরি মন্দির যাওয়ার অটোরিকশা বা ইজিবাইক পাওয়া যায়। শহর থেকে অটোরিকশায় মন্দির পর্যন্ত যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
আপনার মতামত লিখুন :